ইরানের পারস্য উপসাগরে অবস্থিত হরমুজ দ্বীপে ভারী বৃষ্টির পর স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকেরা এক বিরল ও চোখধাঁধানো প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছেন । এক রাতের মধ্যেই দ্বীপটির সৈকত ও অগভীর সমুদ্রের পানি গাঢ় লাল রঙ ধারণ করে, যা অনেকের কাছে রক্তের মতো মনে হয়েছে। ‘রেড বিচ’ নামে পরিচিত এই দৃশ্যের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক কৌতূহল ও উদ্বেগ তৈরি হয়।
প্রথম দেখায় অস্বাভাবিক ও ভীতিকর মনে হলেও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই ঘটনা কোনো দূষণ, রাসায়নিক বিপর্যয় বা পরিবেশগত সংকেত নয়। বরং এটি হরমুজ দ্বীপের অনন্য ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যেরই স্বাভাবিক প্রকাশ।
ভূতত্ত্ববিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, হরমুজ দ্বীপের মাটি ও শিলাস্তরে প্রচুর পরিমাণে আয়রন অক্সাইড বা লোহাজাত খনিজ রয়েছে। বিশেষ করে হেমাটাইট নামের একটি খনিজ এই দ্বীপের ভূ-পৃষ্ঠকে স্বাভাবিকভাবেই লালচে রঙ দেয়। ভারী বৃষ্টিপাতের সময় বৃষ্টির পানি পাহাড়ি ঢাল ও মাটির স্তর বেয়ে নিচে নেমে আসে এবং সেই সঙ্গে লোহা-সমৃদ্ধ সূক্ষ্ম কণাগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় উপকূলের দিকে।
ফলে বৃষ্টির পানি যখন সমুদ্রের অগভীর অংশে গিয়ে মিশে, তখন পানির রঙ গাঢ় লাল হয়ে ওঠে। এতে পুরো সৈকত ও আশপাশের জলরাশি রক্তিম আভা ধারণ করে—যা দেখতে অত্যন্ত নাটকীয় হলেও বৈজ্ঞানিকভাবে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
ভূতাত্ত্বিকদের মতে, যেসব এলাকায় ভূমিক্ষয় তুলনামূলক বেশি, সেখানে এই লাল রঙ আরও স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। হেমাটাইট আর্দ্রতার সংস্পর্শে এলে দ্রুত অক্সিডাইজড হয়—অর্থাৎ লোহা ও অক্সিজেনের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় রঙ আরও গাঢ় ও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই একই খনিজ প্রক্রিয়ার কারণেই মঙ্গল গ্রহকে ‘লাল গ্রহ’ বলা হয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
হরমুজ দ্বীপকে অনেকেই ‘রেইনবো আইল্যান্ড’ বা রঙধনু দ্বীপ নামে চেনেন। এখানে শুধু লাল নয়, হলুদ, কমলা, সাদা ও নানা বর্ণের মাটির স্তর দেখা যায়। হাজার হাজার বছরের আগ্নেয় ও ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের ফলে এই রঙিন খনিজ স্তরগুলো গড়ে উঠেছে। গবেষকদের ভাষায়, পৃথিবীর খুব কম দ্বীপেই এত বৈচিত্র্যময় খনিজ রঙ একসঙ্গে দেখা যায়।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেছেন, এই লাল জোয়ার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় এবং সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপর এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না। এটি কোনো শিল্পবর্জ্য, তেলদূষণ বা বিষাক্ত রাসায়নিকের ফল নয়—বরং দ্বীপটির প্রাকৃতিক খনিজ গঠনেরই অংশ।
ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত হরমুজ দ্বীপ দীর্ঘদিন ধরেই ভূতত্ত্ববিদ, গবেষক এবং পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। দ্বীপটির রঙিন পাহাড়, খনিজসমৃদ্ধ মাটি এবং অনন্য প্রাকৃতিক দৃশ্য একে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পাশাপাশি পর্যটনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। অনেক পর্যটকই বিশেষভাবে বর্ষা বা বৃষ্টির মৌসুমে এখানে আসেন, কারণ এ সময়েই ‘রেড বিচ’-এর মতো দৃশ্য সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার আগ্রহে যেন কেউ পরিবেশের ক্ষতি না করেন। খনিজ মাটি সংগ্রহ বা নির্বিচারে চলাচলের কারণে ভূমিক্ষয় বাড়তে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে দ্বীপটির প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ও ছবিগুলো অনেকের মধ্যে বিস্ময় জাগালেও, বিজ্ঞানীরা বলছেন—এ ধরনের ঘটনা প্রকৃতির শক্তি ও বৈচিত্র্যেরই স্মারক। মানুষের কাছে যা রহস্য বা আতঙ্ক মনে হয়, প্রকৃতির কাছে তা বহু যুগ ধরে চলমান এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
সব মিলিয়ে, ভারী বৃষ্টিতে হরমুজ দ্বীপের সমুদ্রের রক্তিম রূপ কোনো অশুভ সংকেত নয়; বরং এটি পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের এক জীবন্ত প্রদর্শনী। প্রকৃতির এই বিরল রঙিন দৃশ্য আবারও মনে করিয়ে দেয়—পৃথিবী এখনো কত অজানা বিস্ময়ে ভরপুর।
Leave a comment