দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্থির সূচনালগ্নে যখন ইউরোপজুড়ে নাৎসি তাণ্ডব ছড়িয়ে পড়ছে, ঠিক তখনই ইতিহাসের পাতা উল্টে আবির্ভূত হয় এক দুর্বার, রহস্যময় নারী—ক্রিস্টিনা স্কারবেক। ব্রিটিশ স্পেশাল অপারেশনস এক্সিকিউটিভ (SOE)-এর সবচেয়ে সাহসী এজেন্টদের একজন তিনি। যুদ্ধের উন্মত্ততার মাঝেও তাঁর সিদ্ধান্ত, দৃঢ়তা ও সাহসিকতা ছিল অতুলনীয়।
শৈশব: সাহসী এক নারীর জন্ম
১৯০৮ সালে পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া ক্রিস্টিনা বেড়ে ওঠেন অভিজাত কিন্তু সমস্যা জর্জরিত পরিবারে । ছোটবেলা থেকেই ঘোড়দৌড়, স্কি কিংবা শিকার—যেকোনো শারীরিক দক্ষতা অর্জনে তিনি ছিলেন পুরুষদের মতোই পারদর্শী। তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, বহুভাষায় দক্ষতা এবং অসামান্য উপস্থিত বুদ্ধি ভবিষ্যতের গুপ্তচর জীবনের ভিত্তি গড়ে দেয়।
গুপ্তচর জীবনে প্রবেশ: এক অসম্ভব সিদ্ধান্ত
১৯৩৯ সালে জার্মান বাহিনীর হাতে পোল্যান্ড দখল হওয়ার পর নিজের মাতৃভূমিকে রক্ষার ইচ্ছা তাঁকে পৌঁছে দেয় লন্ডনে। সেখানেই তিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তর MI6–কে প্রস্তাব দেন—“আমি জার্মানদের বিরুদ্ধে কাজ করতে চাই।” তরুণ, আকর্ষণীয় এক নারীর গুপ্তচর হওয়ার আবেদন তখন অস্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তাঁর দৃঢ়তা ও যোগ্যতা ব্রিটিশদের দ্রুতই রাজি করায়। এরপরেই তিনি নতুন পরিচয়ে পরিচিত হন—ক্রিস্টিন গ্র্যানভিল, ব্রিটেনের কিংবদন্তি নারী গুপ্তচর।
প্রথম অভিযান: বরফঢাকা তাত্রা পাহাড় পেরিয়ে
স্কারবেকের প্রথম দায়িত্ব ছিল বরফে ঢাকা তাত্রা পাহাড় পাড়ি দিয়ে জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডে গোপন বার্তা পৌঁছে দেওয়া। শীতের তীব্রতায় টহলদার নাৎসি সেনা এড়ানো ছিল মৃত্যুঝুঁকির নামান্তর। কিন্তু স্কিতে দৌড়ে, বরফঝড় উপেক্ষা করে তিনি সফলভাবে প্রতিবারই বার্তা পৌঁছে দিতেন। অনেকের মতে—“তাত্রার বরফঝড়ে বাঁচতে পারে এমন মানুষ গুনে গুনে কয়েকজন—স্কারবেক তাদের একজন।”
গেস্টাপোকে বোকা বানানোর দক্ষতা
তার বুদ্ধিমত্তাই ছিল তাঁর প্রধান অস্ত্র। একবার হাঙ্গেরিতে গেস্টাপোর জেরার মুখে পড়েন তিনি। জেরা থেকে বাঁচতে তিনি অভিনয় করেন যে তাঁর যক্ষ্মা হয়েছে। নিজের জিভ কামড়ে রক্ত বের করে বিষয়টিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হন। আতঙ্কে গেস্টাপো অফিসার তাঁকে ছেড়ে দেয়।এ রকম উপস্থিত বুদ্ধি তাঁকে গোয়েন্দা জগতে আলাদা করে তোলে।
ফ্রান্সে কিংবদন্তি উদ্ধার অভিযান
১৯৪৪ সালে নাৎসিরা ফরাসি প্রতিরোধ যোদ্ধা ও কয়েকজন ব্রিটিশ এজেন্টকে আটক করে, যাদের মধ্যে ছিলেন স্কারবেকের সহযোদ্ধা ফ্রান্সিস ক্যামার্ট। তাদের গুলি করে হত্যা করা হবে—এমন নিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যেই স্কারবেক একাই অভিযান চালান।
ছদ্মবেশে জার্মান সদর দপ্তরে গিয়ে তিনি এক অফিসারকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন যে প্রতিরোধ বাহিনী বিশাল আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে। বন্দীদের হত্যা করা হলে ভয়াবহ প্রতিশোধের মুখে পড়বে জার্মানরা। আতঙ্কিত অফিসার শেষে বন্দীদের মুক্তি দেয়। SOE-এর একাধিক কর্মকর্তা পরে বলেন—“এ রকম অভিযান বইয়ে লেখা হলে কেউ বিশ্বাস করত না। কিন্তু স্কারবেক সত্যিই করেছিলেন।”
যুদ্ধের পর অবহেলা ও ট্র্যাজেডি
যুদ্ধশেষে যখন ইউরোপ বিজয় উদযাপন করছে, স্কারবেক তখন ভিন্ন বাস্তবতায়। অসামান্য অবদানের পরও তিনি পাননি যথাযথ সম্মান। কাজের অভাবে কখনো জাহাজে স্টুয়ার্ডেস, কখনো হোটেলের সহকারী হিসেবে কাজ করতে হয় তাঁকে।
১৯৫২ সালে লন্ডনের এক হোটেলে এক অসন্তুষ্ট প্রাক্তন সহকর্মীর হাতে তিনি নিহত হন। বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৪ বছর। তার সমাধিফলকে লেখা হয়—“She was the bravest of the brave.”
জেমস বন্ডের অনুপ্রেরণা
জেমস বন্ডের স্রষ্টা ইয়ান ফ্লেমিং ব্যক্তিগতভাবে স্কারবেককে চিনতেন এবং তাঁর সাহসের গভীর প্রশংসক ছিলেন। বন্ড সিরিজের “Vesper Lynd” এবং “Tatiana Romanova” চরিত্রের নানা দিক স্কারবেকের জীবন থেকেই অনুপ্রাণিত বলে বহু বিশেষজ্ঞ মনে করেন। ফ্লেমিং একবার তাঁকে বলেছিলেন—“You are the only real spy I’ve ever met.”
ক্রিস্টিনা স্কারবেক ছিলেন বাস্তব জীবনের এক সুপারহিরো—যিনি বন্দুকের জোরে নয়, সাহস, বুদ্ধি এবং মানবিকতা দিয়ে ইতিহাস বদলে দিয়েছিলেন। বরফঢাকা পাহাড় থেকে গেস্টাপোর চোখে ধুলো দেওয়া—প্রতিটি ঘটনার মধ্যেই ছিল তাঁর দুর্বার নারীত্বের শক্তি। তিনি প্রমাণ করে গেছেন— যুদ্ধ শুধু অস্ত্র দিয়ে নয়, অসীম সাহস এবং দ্রুত সিদ্ধান্তের মাধ্যমেও জেতা যায়।
Leave a comment