বিশ্বখ্যাত ইসলামিক বক্তা ডা. জাকির নায়েকের সম্ভাব্য ঢাকা সফর ঘিরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নতুন করে কূটনৈতিক টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছে, জাকির নায়েক বাংলাদেশে পা রাখলে যেন তাঁকে গ্রেপ্তার করে দিল্লির হাতে তুলে দেওয়া হয়।
আগামী ২৮ নভেম্বর দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসার কথা রয়েছে জাকির নায়েকের, যেখানে তিনি একটি দাতব্য অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু সফরের খবর প্রকাশিত হওয়ার পরপরই ভারত সরকার তাঁর বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, “জাকির নায়েক একজন পলাতক আসামি। আমরা আশা করি, তিনি যেখানে যাবেন, সেখানকার সরকার তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে এবং ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ দূর করবে।”
ভারতের এই মন্তব্যের পর বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এস এম মাহবুবুল আলম শনিবার জানান, ভারতের বক্তব্য তাদের নজরে এসেছে। তিনি বলেন, “আমরাও বিশ্বাস করি, অন্য দেশের অভিযুক্ত বা পলাতক ব্যক্তিকে আশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।” এই মন্তব্য থেকেই ধারণা করা হচ্ছে—জাকির নায়েকের ঢাকা সফর হয়তো শেষ পর্যন্ত বাতিল হতে পারে।
২০১৬ সালে ঢাকার হলি আর্টিজান হামলার পর থেকেই ভারতের নজরে আসেন জাকির নায়েক। হামলাকারীদের দুজন তাঁর বক্তব্য দ্বারা প্রভাবিত ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে এবং মানি লন্ডারিংসহ উগ্রবাদে প্ররোচনার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে। একই বছর বাংলাদেশেও পিস টিভি নিষিদ্ধ হয়।
পালিয়ে মালয়েশিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন জাকির নায়েক। সেখানে তিনি আশ্রয় ও বসবাসের অনুমতি পান। তবে ভারত বারবার মালয়েশিয়া ও ইন্টারপোলের কাছে তাঁকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করলেও, তিনবারই রেড নোটিশের আবেদন ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
ভারত মনে করে, জাকির নায়েক শুধু দেশের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ন করেননি, বরং মুসলিম তরুণদের মধ্যে উগ্রপন্থার বীজ বপন করেছেন। জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ডিন শ্রীরাম চৌলিয়া বলেন, “ভারত তাঁকে ফেরত চায় কারণ তিনি ভারতের একটি নেতিবাচক প্রতিচ্ছবি তৈরি করেছেন এবং তরুণ মুসলিমদের ওপর তাঁর প্রভাব উদ্বেগজনক।”
ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর দাবি, দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কয়েকটি ‘স্লিপার সেল’ তাঁর বক্তব্য দ্বারা অনুপ্রাণিত। একইভাবে আল-কায়েদার কয়েকজন সদস্যও জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন যে তাঁরা জাকির নায়েকের বক্তব্যে প্রভাবিত।
সুন্নি ইসলামের সালাফি মতবাদের অনুসারী জাকির নায়েক ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন (আইআরএফ)-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং পিস টিভির প্রধান বক্তা। তাঁর বক্তৃতায় তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব, ইসলাম ও বিজ্ঞান, এবং সামাজিক বিষয়ে বক্তব্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে নারী অধিকার, হিন্দুত্ববাদ ও জিহাদ বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য তাঁকে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ফেলে।
মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক ফেয়ার অবজারভার-এর প্রতিষ্ঠাতা অতুল সিং বলেন, “জাকির নায়েক এমন ধারণা প্রচার করেন যা মানবাধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি বিশ্বাস করেন, পুরুষেরা তাদের স্ত্রীকে ‘হালকা প্রহার’ করতে পারেন—এমন ধারণা আজকের বিশ্বে অগ্রহণযোগ্য।”
এখন প্রশ্ন একটাই—বাংলাদেশ সরকার কি ভারতের কূটনৈতিক চাপের মুখে জাকির নায়েকের সফর বাতিল করবে, নাকি তাঁকে ঢাকায় আসতে দেবে? যেভাবে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে অপরের মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে—এই সফর পরবর্তী কয়েকদিনে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে বড় ধরনের আলোচনার জন্ম দিতে পারে।
সূত্র: রয়টার্স, দ্য হিন্দু, ফেয়ার অবজারভার।
Leave a comment