গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও অস্ত্র-গুলি লুটের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার মামলাকে কেন্দ্র করে ফেনীতে শুরু হয় বহুমাত্রিক ‘মামলা-বাণিজ্য’। স্থানীয় রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, প্রবাসী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত এ বাণিজ্যের শিকার হয়েছেন। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মামলা দায়ের ও আসামির তালিকা প্রণয়ন থেকে শুরু করে জামিন, এমনকি কারাগারের গেট পর্যন্ত নতুন করে আটক না হওয়ার নিশ্চয়তা দিতেও চলে টাকার লেনদেন।
ফেনীর ছোট-বড় অনেক মামলায় আসামিদের নাম আগে থেকে প্রস্তুত খসড়া এজাহারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপে। টাকা দিলে নাম মুছে ফেলা, না দিলে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা—এমন অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ী, চিকিৎসক ও প্রবাসীরা। এমনকি নাম বাদ দেওয়ার জন্য ৪০ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত হাতবদলের প্রমাণ মিলেছে। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী, কারও সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কের ছবি সামাজিক মাধ্যমে পাওয়া গেলেই সেটিকে ভিত্তি করে মামলার খসড়ায় নাম ঢোকানো হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্র জানায়, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মামলাগুলোতে মূল আসামিরা অনেক সময় বাদীর চেনা নয়। বিএনপি, জামায়াত ও যুবদলের কয়েকজন নেতা বাদী নির্বাচন থেকে শুরু করে আসামি নির্ধারণ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বিশেষ করে ফেনী সদর সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুল ইসলাম সিদ্দিকীর নাম নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। তাঁকেসহ দুটি থানার ওসি সম্প্রতি বদলি হলেও মামলার ‘বাণিজ্য চক্র’ এখনও সক্রিয় বলে অভিযোগ।
জামিনপ্রাপ্ত আসামিরাও রেহাই পাচ্ছেন না। কারাফটকে নতুন মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে ৫০ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত—সব দলের স্থানীয় নেতাদের কেউ কেউ এতে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি ঢাকার ব্যবসায়ী ও চট্টগ্রামের জাহাজ ব্যবসায়ীও নিজেদের অজ্ঞাত মামলার আসামি হিসেবে দেখেছেন প্রতিপক্ষের প্রভাবে।
স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, অনেকে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে মামলা ব্যবহার করছেন। তবে তাঁদের দাবি, এ নিয়ে দলীয়ভাবে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফেনী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার বলেন, অভ্যুত্থানে কারা গুলি চালিয়েছে, কারা নির্যাতন করেছে—সবাই জানে, কিন্তু গণহারে আসামি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
ফেনীতে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মোট ২২টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৭টি হত্যা ও ১৫টি হত্যাচেষ্টার অভিযোগ। তাতে এজাহারভুক্ত আসামি ২ হাজার ১৯৯ জন এবং অজ্ঞাতনামা আসামি প্রায় ৪ হাজার। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা ও অর্থ আদায় এখন এই মামলাগুলোর মূল নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে—এমনই মন্তব্য করছেন ভুক্তভোগী ও স্থানীয়রা।

Leave a comment