Home ইতিহাসের পাতা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় ১৫ আগস্ট
ইতিহাসের পাতা

বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় ১৫ আগস্ট

Share
Share

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অন্ধকারময় দিন হিসেবে চিহ্নিত। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। শুধু বঙ্গবন্ধুকেই নয়, তাঁর পরিবার এবং আশেপাশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সেই রাতের ঘটনায় আহত, হতবিহ্বল, এবং বিস্মিত হয়েছিলেন পুরো জাতি। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও তাদের পরিকল্পনা এতটাই সুচারুভাবে গৃহীত ছিল যে, জাতি একেবারে অচেতন অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল।

কালো রাতে, বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুননেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের এবং অন্যান্য পরিবার সদস্যদেরও হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর স্ত্রী আরজু মণি এবং বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াত ও তাঁর পরিবারের সদস্যরাও নিহত হন। সামরিক ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি জাতির স্বপ্ননির্মাতা ব্যক্তিত্বকে অচেতন করে দেওয়া হয়।

ঘাতকদের পরিকল্পনা অত্যন্ত নিখুঁত ছিল। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মোহিতুল ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী, ভোরের আগামি মুহূর্তে ফোনযোগে বঙ্গবন্ধু জানতে চাইছিলেন সেরনিয়াতের বাসায় হামলার খবর। তখনই বাইরে থেকে গুলি বর্ষণ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ও সহকারীরা নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন, কিন্তু বাড়ির বড় সন্তান শেখ কামাল, ছোট সন্তান শেখ রাসেল এবং অন্যান্য সদস্যদের ওপর খুনীদের নিষ্ঠুর আগ্রাসন অব্যাহত থাকে। ছোট্ট রাসেলের প্রাণভয় আর আর্তি কিছুতেই খুনীদের মন গলাতে পারেনি।

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক এবং সামরিক ষড়যন্ত্র জড়িত ছিল। পরবর্তী সময়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করে খুনীদের দায়মুক্তি নিশ্চিত করেন। এতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়নি। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ওই অধ্যাদেশের বৈধতা নিশ্চিত করেন। খুনীদের অনেককে বিদেশে কূটনৈতিক দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল।

যদিও বিচার দীর্ঘ সময় স্থগিত থাকলেও ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ পুনরায় উন্মুক্ত করা হয়। নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ২০০৯ সালে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল হত্যাকারী আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তবে খুনিরা এখনও নানা দেশে পালিয়ে রয়েছেন।

১৫ আগস্ট কেবল একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নয়, এটি জাতীয় ও মানব ইতিহাসে এক নৃশংস অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি ছিলেন না; তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক। তাঁর হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও স্বাধীনতার আদর্শকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। তবে তার মৃত্যুর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু অমর হন, কারণ তার স্বপ্ন, আদর্শ এবং সংগ্রামের দর্শন বাঙালির চেতনায় চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করেছে।

জাতি আজও বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ও পরিবারের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডকে স্মরণ করে। ১৫ আগস্ট শোকের দিন হলেও এটি জাতির ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন, যা প্রমাণ করে যে স্বাধীনতা অর্জন করা সহজ নয়। বঙ্গবন্ধুর জীবন, আত্মত্যাগ এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ড আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য, স্বাধীনতার মূল্য ও গণতন্ত্রের স্বার্থে চিরকাল মনে থাকবে। বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব, কারণ তার আদর্শ, দর্শন ও নেতৃত্ব বাঙালি জাতিকে একত্রিত এবং শক্তিশালী করেছে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পরিবারকে নয়, গোটা জাতিকে আঘাত করেছিল। তবে জাতি তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শকে বুকে ধরে রেখেছে। ১৫ আগস্ট আমাদের শোকের দিন হলেও তা আমাদের জন্য প্রতিশ্রুতির দিনও—স্বাধীনতা, ন্যায়, গণতন্ত্র এবং জাতীয় ঐক্যের প্রতিশ্রুতি। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও ত্যাগ আমাদের চেতনা ও সংগ্রামের পথপ্রদর্শক। ইতিহাসের এই অন্ধকার অধ্যায় আমাদের শেখায় যে স্বাধীনতা রক্ষায় vigilance ও সতর্কতা কখনও হ্রাস পাবে না।

জাতি ১৫ আগস্ট প্রতিটি বছর গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় স্মরণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের জীবন ও মৃত্যু বাঙালি জাতির জন্য এক অমোচনীয় স্মৃতি। এই দিন আমাদের জাতীয় চেতনাকে উদ্দীপ্ত রাখে, আমাদের শেখায় যে স্বাধীনতা অর্জন সহজ নয় এবং ইতিহাসের নৃশংস অধ্যায়গুলোর স্মৃতি চিরকাল ধরে রাখার প্রয়োজন।

এইভাবে ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরকাল অম্লান শোক ও স্মৃতির দিন হিসেবে থাকবে, যা বাঙালি জাতিকে একত্রিত করে রাখে, স্বাধীনতার স্বপ্নকে জীবিত রাখে এবং জাতীয় নেতৃত্ব ও নৈতিকতার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের এই কাহিনী শুধু শোক নয়, এটি জাতিকে সতর্ক ও শক্তিশালী রাখার প্রতীক। জাতি চিরকাল স্মরণ করবে, শিখবে এবং প্রেরণা নেবে—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ও আদর্শ অনুসরণ করে স্বাধীনতা, ন্যায় ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে।

 

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don't Miss

মৌলভীবাজারে বড় ভাইকে কুপিয়ে হত্যার দায় স্বীকার ছোট ভাইয়ের

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় বড় ভাই আব্দুর রহিম রাফি (৩২) নামে এক ছাত্রদল নেতাকে কুপিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন তার ছোট ভাই আব্দুল করিম...

১৬২ দিনে কোরআনে হাফেজ হলেন চাঁদপুরের সাব্বির

চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার মাদ্রাসা-ই শাজুলিয়ার ছাত্র মো. সাব্বির হোসেন ১৪ বছর বয়সে, মাত্র ১৬২ দিনে সম্পূর্ণ পবিত্র কোরআন মুখস্ত করে হাফেজ হওয়ার গৌরব...

Related Articles

আজ রোববার ১০ আগস্ট-  কী ঘটেছিল ইতিহাসের আজকের এই দিনে

সময়ের স্রোত কারও জন্য থেমে থাকে না। প্রতিটি দিনই ইতিহাসের পাতায় নতুন...

১৮ বছর বয়সে শহীদ : ভারতীয় স্বাধীনতার অমর প্রতীক ‘ক্ষুদিরাম’

১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। এই...

আজ রোববার ১০ আগস্ট-  কী ঘটেছিল ইতিহাসের আজকের এই দিনে

সময়ের স্রোত কারও জন্য থেমে থাকে না। প্রতিটি দিনই নতুন করে যুক্ত...

বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট – কী ঘটেছিল ইতিহাসের আজকের এই দিনে

সময়ের স্রোত কারও জন্য থেমে থাকে না। প্রতিটি দিনই নতুন করে যুক্ত...