নয়া দিল্লি থেকে পাওয়া একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে ভারত তার দীর্ঘদিনের নীতি থেকে সরে আসছে। বর্তমানে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনার বিষয়ে একটি সতর্ক ও দূরত্ব বজায় রাখার কৌশল নিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত এখন কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা দলকে নয়, বরং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে আগ্রহী এবং এ লক্ষ্যে নীরবে নিজেদের ঘুঁটি সাজাচ্ছে।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে ভারত এক ধরনের উভয় সংকটে পড়েছে। একদিকে তারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দিলেও, এই সরকারের ব্যাপারে তাদের মনোভাব খুব একটা ইতিবাচক নয় বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিলেও তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। তাকে কোনো প্রকার রাজনৈতিক সভা, দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক এমনকি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সুযোগও দেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ লন্ডনে থেকে ভারতে এসে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রায় তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের অবস্থাও তথৈবচ।
কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারত দেরিতে হলেও উপলব্ধি করেছে যে, বিগত বছরগুলোতে এককভাবে আওয়ামী লীগের উপর নির্ভর করে তারা কৌশলগত ভুল করেছে। এর परिणामে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব তীব্র হয়েছে এবং হাসিনার পতনের পর ভারতের প্রভাব বলয়ে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন কোনো শক্তি নেই যা প্রকাশ্যে ভারতের পক্ষে কথা বলছে। এই বাস্তবতা মেনেই ভারত এখন শেখ হাসিনার বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দুই দেশের সম্পর্ক বর্তমানে ইতিহাসের অন্যতম শীতল পর্যায়ে রয়েছে। ভারত বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সীমিত করে এনেছে, ভিসা প্রক্রিয়া কঠোর করেছে এবং সীমান্তে হত্যা ও পুশ-ইনের মতো ঘটনাগুলো অব্যাহত রয়েছে। মাইলস্টোন স্কুল ট্র্যাজেডির পর ভারত মানবিকতার খাতিরে চিকিৎসক দল পাঠালেও সার্বিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তার কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দিল্লিতে একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিককে হাইকমিশনার হিসেবে পাঠিয়েছে। তিনি দৌড়ঝাঁপ করলেও সম্পর্কের বরফ গলাতে পারছেন না, কারণ এর জন্য প্রয়োজন উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
সামনেই বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ভারত চায়, সেই নির্বাচন যেন সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়। তবে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক মেরূকরণ এবং ডানপন্থী শক্তির উত্থান নিয়ে নয়া দিল্লির হিসাব-নিকাশ জটিল হয়ে পড়েছে। ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা এখন মনে করছেন, শেখ হাসিনার উপর শতভাগ নির্ভর না করে বাংলাদেশে একটি বিকল্প নেতৃত্ব বা শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন ছিল। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই তারা এখন একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে চাইছে, যেখানে ব্যক্তির চেয়ে দেশ হিসেবে বাংলাদেশই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দিনগুলোতে ভারতের এই পরিবর্তিত কৌশলের প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
Leave a comment