Home স্মরণে বাংলা সাহিত্যের হীরকখণ্ড ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ
স্মরণে

বাংলা সাহিত্যের হীরকখণ্ড ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ

Share
Share

বাংলা সাহিত্যের এক প্রগাঢ় আলোকবর্তিকা, হুমায়ূন আহমেদ, আজও বহমান এক নদীর মতো বয়ে চলেছেন পাঠকের হৃদয়ে। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোণার মোহনগঞ্জে জন্ম নেওয়া এই প্রতিভাবান সাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক এবং অধ্যাপক তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে রেখে গেছেন গভীর প্রভাব। বাংলা সাহিত্যকে তিনি শুধু সমৃদ্ধ করেননি, গড়ে তুলেছেন নতুন পাঠকপ্রজন্ম, তৈরি করেছেন এমন সব চরিত্র—যারা আজও জীবন্ত এক বাস্তবতা হয়ে ছড়িয়ে আছে মানুষের ভাবনায়, কথায়, প্রেমে ও প্রেরণায়।

ছেলেবেলা থেকেই বইয়ের সঙ্গে ছিল তার অন্তরঙ্গতা, আর লেখালেখির অনুপ্রেরণার পেছনে কাজ করেছিল তার সাহিত্যপ্রেমী পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান ও এক সাহিত্যসচেতন পরিবার। বাবা পুলিশ অফিসার হলেও সাহিত্যে ছিল তার অগাধ ঝোঁক, যেটি হুমায়ূনের চিন্তাজগতে গভীর ছাপ ফেলে। লেখাপড়ায় ছিলেন অসাধারণ, ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে অনার্স-মাস্টার্স করেন, পরে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি।

তবে তার জীবনের আসল অধ্যায় শুরু হয় লেখালেখিতে আত্মনিয়োগের মধ্য দিয়ে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন শৈলীর সূচনা করে। এরপর একের পর এক উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, চলচ্চিত্র, এমনকি গান রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সৃষ্টি করেছেন এক অলঙ্ঘনীয় আসন। তার লেখা ছিল সংলাপপ্রধান, বাস্তব ও অতিবাস্তবতার মিশেলে গড়া, যা সহজেই পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে যেত।

তার সৃষ্ট মিসির আলি, হিমু ও শুভ্র—এই তিন চরিত্র যেন ভিন্ন দর্শনের তিন মহাসড়ক, যেখানে একদিকে যুক্তির মিশেল, অন্যদিকে একাকীত্ব ও নিরুদ্বেগের দার্শনিকতা, আবার কোথাও বা শুদ্ধতার অনুসন্ধান। তিনি কখনও পাঠককে নসিহত করেননি, বরং গল্প বলেই পাঠককে ভাবতে শিখিয়েছেন। তার ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘বহুব্রীহি’ নাটকগুলো হয়ে উঠেছিল জাতীয় সংলাপের অংশ, যেখানে বাকের ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে রাজপথে মানুষের স্লোগান ছড়িয়ে পড়েছিল ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’।

হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত হন, অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। সেই ট্র্যাজেডির স্মৃতি তার সাহিত্যে নানা রূপে ফিরে এসেছে। তার চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ থেকে ‘শ্যামল ছায়া’, ‘ঘেটু পুত্র কমলা’—প্রতিটিতেই ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের আত্মা। পরিচালক হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা অর্জন করেন।

ব্যক্তিজীবনেও হুমায়ূন ছিলেন নাটকীয়তার প্রতিচ্ছবি। গুলতেকিন খানের সঙ্গে দীর্ঘ বৈবাহিক সম্পর্ক, পরবর্তীতে মেহের আফরোজ শাওনের সঙ্গে নতুন জীবন, সন্তান, বিচ্ছেদ ও পুনর্মিলনের গল্পগুলোও ছিল মিডিয়ার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তবে এসবের মাঝে কখনও থেমে যায়নি তার কলম। ২০১১ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি, চিকিৎসার জন্য যান যুক্তরাষ্ট্রে। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে অবশেষে ২০১২ সালের ১৯ জুলাই মৃত্যু হয় তার, আর সেই সঙ্গে নিভে যায় বাংলার এক সাহিত্যের মহাতারা। তাকে গাজীপুরের ‘নুহাশ পল্লী’-তে সমাহিত করা হয়, যে স্থান আজ তার ভক্তদের কাছে এক তীর্থস্থান।

তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষক, গবেষক, প্রেমিক, বাবা, গীতিকার, নির্মাতা, গল্পকার ও জীবনদর্শনের দার্শনিক। তার রচনা শুধু বিনোদনের বাহন নয়, মানবিকতা ও জীবনের নানামাত্রিকতার এক বিশাল পাঠশালা। তার মৃত্যু নয়, বরং অমরতার শুরু—সাহিত্য-সংস্কৃতি-চিন্তায়।

হুমায়ূন আহমেদ বাংলা ভাষাকে দিয়েছিলেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, সাহিত্যে এনে দিয়েছিলেন এক ভিন্নমাত্রা। জীবনের রসায়নে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাহিত্যের যাদুকর। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি যা রেখে গেছেন, তা এক মহাকাব্যিক অর্জন। এবং আজও যেখানেই পাঠক হৃদয়, সেখানেই জীবন্ত হয়ে ওঠে হুমায়ূনের কোনো এক চরিত্র, কোনো এক সংলাপ, কোনো এক গভীর আবেগ।

 

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don't Miss

এনসিপির সমাবেশে হামলায় জড়িতরা ছাড় পাবে না: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী মন্তব্য করে বলেছেন, গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলার ঘটনায় যারা জড়িত তাদের কাউকে কোনোরকম ছাড়...

মাদারীপুরে পুকুর থেকে উদ্ধার হয়েছে নিখোঁজ মাদ্রাসা ছাত্রীর মরদেহ

মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায় নিখোঁজের একদিন পর পুলিশ লামিয়া আক্তার (১৫) নামে নবম শ্রেণির এক মাদ্রাসা ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করেছে। উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের আব্দুল...

Related Articles

আজ কোটা সংস্কার আন্দোলনের শহীদ মীর মুগ্ধর প্রথম শাহাদাৎ বার্ষিকী

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের এক স্মরণীয় নাম শহীদ মীর...

আজ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী

আজ ৩০ মে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। এদিনটিকে কেন্দ্র করে...

আজ জাতীয় কবির ১২৬তম জন্মবার্ষিকী। 

আজ   ১১ জ্যৈষ্ঠ সাম্য, প্রেম ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল  ইসলামের ১২৬তম...

আজ ৫২’এর ভাষা সৈনিক আবদুল গাফফার চৌধুরী্র প্রয়াণ দিবস

২০২২ সালের ১৯ মে, লন্ডনের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কালজয়ী...