দুই সপ্তাহের ব্যবধানে গাজা যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট চারজন ইসরায়েলি সেনাসদস্য আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে দেশটির স্থানীয় সংবাদমাধ্যম। ইসরায়েলের প্রভাবশালী দৈনিক হারেৎজ–এর খবরে বলা হয়েছে, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে দুজন ছিলেন বাধ্যতামূলক সামরিক সেবায় নিয়োজিত কনস্ক্রিপ্ট এবং বাকি দুজন রিজার্ভ সেনা, যাঁরা গাজায় কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধে অংশগ্রহণ শেষে সদ্য দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন।
এ ঘটনাগুলো এমন সময় ঘটল, যখন দক্ষিণ গাজার বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করেছে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। হামাসের হাতে সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েলি সেনাদের অপহরণের চেষ্টা, অতর্কিত আক্রমণ ও আত্মঘাতী হামলার ঘটনাও বেড়েছে। এসব পরিস্থিতি সেনাদের মধ্যে মানসিক চাপ ও হতাশা আরও তীব্র করে তুলছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
এর আগে টাইমস অব ইসরায়েল জানায়, এক সেনাসদস্য আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে যান, তবে গুরুতর আহত হয়েছেন। গাজা যুদ্ধের সূচনা থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা একের পর এক বেড়েই চলেছে। হারেৎজ–এর তথ্যানুসারে, চলমান যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৪৩ সেনা আত্মহত্যা করেছেন। কেবল ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে আত্মহত্যার সংখ্যা ১৪, যা একটি অস্বাভাবিক উচ্চ হার।
সেনাদের মধ্যে আত্মহত্যার এই উদ্বেগজনক প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স–এ দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, “এই যুদ্ধ আত্মাকেও হত্যা করে।” লাপিদ সেনাদের আত্মহত্যার ঘটনাকে ‘অসহনীয়’ উল্লেখ করে বলেন, এটা শুধু মৃত্যু নয়, একেকটা পরিবার ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা।
মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থাগুলো বলছে, ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে প্রকৃত আত্মহত্যার সংখ্যা সরকারি হিসেবে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়েও বেশি হতে পারে। কারণ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী, যারা নিয়মিত দায়িত্বে ছিলেন না, তাঁদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলো সাধারণত পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। হারেৎজ জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অন্তত ১২ জন সেনা আত্মহত্যা করেছেন, যাঁদের মৃত্যু সেনাবাহিনীর অফিসিয়াল পরিসংখ্যানে আসেনি, যদিও তাঁদের যুদ্ধ-সম্পর্কিত দায় বা মানসিক আঘাত ছিল স্পষ্ট।
সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলোর বরাতে হারেৎজ জানায়, বেশিরভাগ আত্মহত্যার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে তীব্র মানসিক অভিজ্ঞতা ও সহিংসতার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ যুক্ত। গাজায় প্রায় দুই বছর ধরে চলা এই যুদ্ধ ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর যেমন ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে, তেমনি ইসরায়েলি সেনাদের মাঝেও হতাশা ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত তৈরি করেছে।
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে এখন পর্যন্ত ৫৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে কমপক্ষে ১৭ হাজার শিশু। অপরদিকে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হতাহতের শিকার হয়েছে। ইসরায়েলি সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ৮৯৩ সেনা নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর ৪৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১৯ হাজার।
এই পরিস্থিতি ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর ভেতরে গভীর মনস্তাত্ত্বিক সংকট ও নীতিগত প্রশ্ন তুলছে। একদিকে যুদ্ধের কৌশলগত ব্যর্থতা, অন্যদিকে দীর্ঘ সময় ধরে চলা সংঘাতের কারণে হতাশা, ক্লান্তি ও যুদ্ধ-পরবর্তী ট্রমা সেনাদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান এই আত্মধ্বংসী প্রবণতা ইসরায়েলি সমাজের জন্য এক গভীর ও জটিল সংকেত বয়ে আনছে।
তথ্যসূত্র: মিডল ইস্ট আই
Leave a comment