মুহাম্মাদ বিন কাসিম আস সাকাফি ছিলেন উমাইয়া খিলাফতের অন্যতম প্রতিভাবান ও সাহসী সেনাপতি, যিনি ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৭ বছর বয়সে সিন্ধু নদীর উপত্যকা দখল করে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের পথ উন্মুক্ত করেন। তাঁর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ব্রাহ্মণ শাসিত সিন্ধেতে অভিযান চালিয়ে রাজা দাহিরের শক্তি ভেঙে দেন, আরোরা, দেবল, মুলতানসহ প্রধান শহরগুলো দখল করেন। দাহির পরাজিত ও তার শিরশ্ছেদ এই বিজয়ের প্রতীক হয়ে রয়ে যায়, যা ইসলামী ইতিহাসে একটি অধ্যায় হয়ে উৎসর্গিত হয়।
মুহাম্মাদ বিন কাসিম তায়েফ (আরব উপদ্বীপ) ওয়ালিদ খলিফা ও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের অধীনে লালিত-পালিত হন। যুদ্ধবিদ্যা থেকে প্রশাসনিক দক্ষতা—সবকিছুই শেখার পর তিনি ৭০৮ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু অভিযানের নেতৃত্ব পান। তিনি অত্যন্ত সৈন্যদক্ষ, দৃঢ় মনোবল ও প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই কার্যকর ছিলেন।
সিন্ধু জয় করার পর মুহাম্মাদ স্থানীয়দের সঙ্গে এক ধরণের সহনীয়তা প্রদর্শন করেন। যুদ্ধপ্রধান জায়গাগুলোতে শক্তিশালী প্রতিরোধের জন্য কড়াকড়ি চালানো হলেও বেশিরভাগ অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ দখল প্রাধান্য পায়। তিনি ইসলামি আইন প্রয়োগের পাশাপাশি অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতা, জায়গা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। লোকজনকে ‘জিজিয়া’ কর ব্যবস্থা অনুযায়ী সম্মান ও সুবিধার বিনিময়ে নির্দিষ্ট কর প্রদান করার সুযোগ দেয়া হয়। স্থানীয় প্রশাসনে ব্রাহ্মণ, বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন, যা ছিল ইতিহাসে যুগান্তকারী উদারনীতি।
তবে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয় নিয়ে বিতর্কও রয়েছে; বিশেষ করে ধর্মান্তর ও মন্দির ধ্বংসের প্রসঙ্গ। কিছু ঐতিহাসিক অভিযোগ করেন যে ইসলামী শাসনের আওতায় ভ্রান্ত উপাচার ও ধর্মান্তর প্রবণতা ছিল। তবে সমসাময়িক মুসলিম ইতিহাস ঐতিহাসিকদের বিবৃতিতে এসব দাবি সমর্থিত নয়; বরং জয়োন্নতময় বিজয় ও প্রশাসনে ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
৭১৪ খ্রিস্টাব্দে হাজ্জাজের মৃত্যু ও নতুন খলিফা সুলাইমানের ক্ষমতাসীন হলে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়। তিনি ইরাকে গ্রেফতার ও নির্বাসিত হন। ৭১৫ সালের ১৮ জুলাই মসুলে মৃত্যুবরণ করেন। ইতিহাসে তাঁর মৃত্যু নির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যাত না হলেও, অনেকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও প্রতিশোধমূলক আদেশকে দায়ী করে থাকেন।
মুহাম্মাদের প্রশাসন ও বিজয়ের ইতিহাস শাসন, নীতি ও তত্ত্বের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তার সাফল্য কেবল সামরিক জয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না—স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্মীয় সহাবস্থাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সমন্বিত শাসন ব্যবস্থা, যা পরবর্তী সময়ে ইসলাম উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রেরণা যুগিয়েছে।
আজকের প্রেক্ষাপটে তাঁর বিজয় ও আদর্শ রাজনীতিক, সৈনিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে গভীর বিশ্লেষণ ও গবেষণার প্রয়োজনীয় বিষয়। সিন্ধু জয় শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়—তেমনই এটি প্রশাসন, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের এক অনন্য প্রতীক হিসেবেও স্মরণীয়।
এই সব যুক্তি ও তথ্য একত্রিত করে মুহাম্মাদ বিন কাসিম কেবল সেনাপতি ছিলেন না, বরং একজন যুগান্তকারী শাসক ও সংস্কারকেও ছিলেন, যাঁর কর্মকাণ্ড ভারত ও পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।
Leave a comment