রাজধানীর পুরান ঢাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে কংক্রিট বোল্ডার দিয়ে মাথা থেঁতলে মো. সোহাগ (৪৩) নামের এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় সারাদেশে তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও আতঙ্ক। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব, আর বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল থেকে পাঁচজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ঘটনার ভিডিও দেখে অনেকেই শিউরে উঠেছেন। এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে—এই ভয়াবহ সহিংসতা কি নিছক ব্যবসায়িক বিরোধ, নাকি এটি রাজনীতির নামে সৃষ্ট অপরাধ সিন্ডিকেটের প্রকাশ্য উন্মাদনা?
গত বুধবার (৯ জুলাই) বিকেলে রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালে ৩ নম্বর ফটকের সামনে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ভাঙারি ও পুরনো তারের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মো. সোহাগকে কংক্রিটের পাথর দিয়ে মাথায় ও শরীরে আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর তার নিথর দেহের ওপর দাঁড়িয়ে হামলাকারীদের কেউ কেউ উল্লাস প্রকাশ করে, যা ভিডিও ফুটেজে ধরা পড়ে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। এতে সাধারণ মানুষের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়।
পুলিশ জানায়, ঘটনার পরপরই কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন নিহত সোহাগের বড় বোন। মামলায় ১৯ জনকে আসামি করা হয়। এরই মধ্যে র্যাব ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে মাহমুদুল হাসান মহিন (৪১) ও তারেক রহমান রবিন (২২) নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে। রবিনের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। র্যাব আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। মহিন ও রবিনকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
স্থানীয়রা জানান, পুরান ঢাকার পুরনো তার ব্যবসার একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ছিল, যার নেতৃত্ব দিতেন নিহত সোহাগ। ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলেন মহিন ও তার সহযোগীরা। তাদের সঙ্গে সোহাগের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের, একাধিকবার বৈঠক হয়েছে, উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এমনকি কিছুদিন আগে সোহাগের গোডাউনে তালাও মেরে দেয় মহিনের পক্ষের লোকজন।
জানা গেছে, এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের অনেকেই রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত। গ্রেপ্তারকৃতদের কেউ কেউ যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। মামলার প্রধান দুই আসামি যুবদলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাবেক সহ–জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক রজ্জব আলী পিন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সাবাহ করিম লাকিকে বহিষ্কার করেছে যুবদল। দলটির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রাথমিক সদস্য পদসহ আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে ওই দুই নেতাকে। একইভাবে স্বেচ্ছাসেবক দল তাদের এক কর্মী কালুকেও বহিষ্কার করেছে। চকবাজার থানা ছাত্রদলের সদস্য সচিব অপু দাস ও এক সময় ছাত্রদলে জড়িত মাহমুদুল হাসান মহিনকেও ছাত্রদল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মফিজুল ইসলাম বলেন, “নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আমরা নিশ্চিত করতে চাই, কেউই এই ঘটনার বাইরে থাকবেন না। ভিডিও এবং সিসিটিভি ফুটেজ, মোবাইল রেকর্ড ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান বিশ্লেষণ করে প্রকৃত কারণ ও জড়িতদের শনাক্ত করার কাজ চলছে।”
এই ঘটনাকে ঘিরে রাজনীতির মাঠেও প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। গণসংহতি আন্দোলন এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, “এই নৃশংসতার রাজনীতি আর চলতে পারে না। হত্যার ভিডিও দেখে পুরো জাতি হতবাক। এই বর্বরতার সঙ্গে জড়িতদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।” বিবৃতিতে বলা হয়, “মানুষের ভয়কে পুঁজি করে রাজনীতি করার অপচেষ্টা আমরা আগেও দেখেছি। এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কঠোরভাবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে।”
অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “যেভাবে প্রকাশ্যে একজন মানুষকে কংক্রিট দিয়ে পিটিয়ে মারা হলো, তারপরও তাঁর নিথর দেহে আঘাত করা হলো—এটি মানবিক শোক নয়, এটি এক ধরনের রাজনৈতিক নৃশংসতার বহিঃপ্রকাশ। এসব ঘটনায় বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।” তিনি বলেন, “আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই এখন একমাত্র উপায়। দ্রুততম সময়ে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।”
একই মত প্রকাশ করেন প্রবীণ অপরাধ সাংবাদিক ও ‘আজকের পত্রিকা’র ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কামরুল হাসান। তিনি বলেন, “বিচারহীনতার সংস্কৃতি যতদিন থাকবে, ততদিন এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। রাষ্ট্র যখন তার কার্যকারিতা হারায়, তখনই মানুষ নিজেই বিচারক হয়ে উঠে। এটাই ভয়াবহ। রাজনীতি, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় দায়িত্বহীনতা তৈরি করেছে এই চক্র। এটি রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছার পাশাপাশি প্রশাসনিক জবাবদিহিতা জরুরি।”
ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজ সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক তৈরি করেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এমন একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়, যেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা, পুলিশ ও হাসপাতাল আছে, সেখানে কীভাবে এমন প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড ঘটে যায় এবং আশপাশের মানুষ কেউই কেন বাধা দেয় না?
এই ঘটনায় সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকেও প্রতিক্রিয়া এসেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিফিংয়ে বলেছেন, “এই ধরনের অপরাধ বরদাশত করা হবে না। যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।”
অবশ্য রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকা ব্যক্তিদের বহিষ্কার শুধু দল থেকে নয়, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা জরুরি বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, শুধুমাত্র দলীয় চিঠিতে আজীবন বহিষ্কার করলেই দায় শেষ হয় না, বরং বিচারিক প্রক্রিয়ায় কঠোর শাস্তি নিশ্চিত না হলে অপরাধীদের বার্তা যাবে না।
এদিকে নিহত মো. সোহাগের পরিবারের সদস্যরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তারা দৃষ্টান্তমূলক বিচার চান। সোহাগের স্ত্রী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার স্বামীকে ওরা কেন এভাবে মেরে ফেললো? কী অপরাধ ছিল ওর? আমি শুধু চাই, ওদের ফাঁসি হোক, যেন আর কোনো স্ত্রীকে এমনভাবে স্বামী হারাতে না হয়।”
এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি ব্যবসা বা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সীমায় সীমাবদ্ধ নয়—এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার এক গভীর সংকেত। সমাজে যে সহিংসতা ও প্রতিহিংসার সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করেছে, তার রাশ টানতে না পারলে আগামী দিনে আরও ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে বলে সতর্ক করছেন অনেকে।
একের পর এক নৃশংসতা ও প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ডের পরও যদি বিচার না হয়, দায়ীদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে দেশের নাগরিক সমাজ আরও একধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। অতীতের অনেক ঘটনার মতো যেন এই ঘটনাও সময়ের স্রোতে মুছে না যায়—সেই প্রত্যাশা আজ প্রতিটি সচেতন নাগরিকের।
Leave a comment