Home জাতীয় গুমের শিকার ব্যক্তিদের শেষ পরিণতি চার ধরনের: তদন্ত কমিশন
জাতীয়

গুমের শিকার ব্যক্তিদের শেষ পরিণতি চার ধরনের: তদন্ত কমিশন

Share
Share

 

গুম সংক্রান্ত তদন্তে ২৫৩ জন জীবিত ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে স্পষ্টভাবে চারটি সম্ভাব্য পরিণতির চিত্র তুলে ধরেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন বা কাকতালীয় নয়, বরং সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য পদ্ধতিগতভাবে পরিচালিত ছিল বলেও জানিয়েছে কমিশন। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে কমিশনের নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কমিশনপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।

সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কমিশনে জমা অভিযোগ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের চারটি সম্ভাব্য পরিণতি ঘটেছে। প্রথমত, ভুক্তভোগীকে হত্যা করা হয়েছে; দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যমের সামনে ‘জঙ্গি’ তকমা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে; তৃতীয়ত, সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে সেখানকার বাহিনীর মাধ্যমে গ্রেপ্তার করানো হয়েছে; এবং চতুর্থত, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মামলা না দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিচারপতি মইনুল বলেন, বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের শাসনামলে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে দমননীতির অস্ত্র হিসেবে ‘গুম’-কে একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরও বহু অপরাধী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে রয়ে গেছে, ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ও আলামত ধ্বংস হয়েছে। তিনি জানান, গোপন আটককেন্দ্রগুলোর অস্তিত্ব এখন আর অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই কয়েকটি আটককেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন এবং ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা শুনেছেন, যা গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশ-বিদেশে প্রচারিত হয়েছে।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে মোট ১৬টি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করা হয়েছে। ১,৮৫০টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে ২৫৩ জন গুম হওয়া ব্যক্তির তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, যাঁরা তিনটি পর্যায়ে তথ্যপ্রমাণ দাখিল করতে পেরেছেন: নিখোঁজ হওয়ার সময়ের ডায়েরি বা মামলা, গুমকালীন সংবাদ প্রতিবেদন এবং ফিরে আসার পর আইনি স্বীকৃতি ও অভিজ্ঞতা। এঁদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো সময় রাষ্ট্রীয় হেফাজতে ছিলেন এবং গোপন আটক কেন্দ্রে বন্দী ছিলেন বলে জানান।
বিচারপতি মইনুল আরও বলেন, এই অভিজ্ঞতাগুলোর আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে—যা কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হতে পারে না। বিভিন্ন সময় ও স্থান থেকে গুম হওয়া ব্যক্তিরা প্রায় একই ধরনের প্রক্রিয়া, নির্যাতন ও আচরণের মুখোমুখি হয়েছেন। কমিশন এই প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে মনে করছে, এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং সাংগঠনিক পরিকল্পনার অংশ ছিল, যার মূল লক্ষ্য ছিল বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে দমন, আন্তর্জাতিকভাবে ‘জঙ্গিবিরোধী রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন এবং ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করা।
কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ওই ২৫৩ জনের বেশিরভাগই ছিলেন বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী, কিছু ক্ষেত্রে শাসক দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকারও ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে একই ধরনের সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগ করা হয়েছে এবং প্রায় একই ভাষায় প্রচার মাধ্যমে ‘জঙ্গি’ তকমা দেওয়া হয়েছে। কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এই অভিজ্ঞতাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রাজনৈতিক ব্যবহারকে প্রতিফলিত করে।
এছাড়াও কমিশন জানায়, তাদের কাছে দাখিল করা ৮১ শতাংশ অভিযোগ জীবিত ফিরে আসা ভুক্তভোগীদের; ১৯ শতাংশ অভিযোগ হলো যাঁরা এখনো ফেরেননি। ফেরত না আসা ১২ জনের বিষয়ে তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে এবং তাদের গুমের পেছনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তবে চলমান অনুসন্ধানের স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হয়নি।
গুম নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে কমিশন যেসব প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে—প্রাতিষ্ঠানিক অসহযোগিতা, সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, পুরোনো কললিস্ট না পাওয়া এবং বিভিন্ন সময়ে তথ্যপ্রাপ্তির বিলম্ব। তারপরও কমিশন বলেছে, তারা আন্তরিকভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এবারের প্রতিবেদনে কমিশন দুটি সুপারিশ দিয়েছে: সন্ত্রাসবিরোধী মামলাগুলোর অপব্যবহার রোধ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিচারিক প্রক্রিয়া জোরদার করা এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘কাউন্টার টেররিজম’ নীতির পরিবর্তে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার মতো কার্যকর পদ্ধতির অনুসন্ধান করা। কারণ বর্তমান পদ্ধতি ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে বলে কমিশনের অভিমত।
কমিশনপ্রধান বলেন, “সন্ত্রাসবাদ সত্যিই একটি হুমকি, কিন্তু সেই হুমকি মোকাবিলায় রাষ্ট্র যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বেআইনি পন্থা অবলম্বন করে, তবে তা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইনের শাসন ও নাগরিক আস্থার চরম ক্ষতি করে।”
এই তদন্ত কমিশন গত ১৫ সেপ্টেম্বর গঠিত হয়। কমিশনের কাজ হলো—বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, কারা গুম করেছেন তা শনাক্ত এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রদান। কমিশন তাদের কাজের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে ১৩১টি অভিযোগ পাঠিয়েছে, যাতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের অন্যান্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁরা জানান, গুম শুধু একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় নয়, বরং এটি একটি রাষ্ট্রীয় নীতির ফল, যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
তথ্যসূত্র: বাসস

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don't Miss

পুরোনো বিমানবন্দরে ‘এয়ার শো’ দেখতে মানুষের ঢল

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে আয়োজিত বিশেষ ‘এয়ার শো’ দেখতে মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) সকাল থেকেই মানুষের ঢল নেমেছে। উৎসবমুখর পরিবেশে...

বিজয় দিবসকে ঘিরে দেশজুড়ে র‌্যাবের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রস্তুতি

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সারাদেশে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, জনসমাগমস্থল এবং বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত...

Related Articles

সিলেটে তরুণদের বিদেশমুখিতা বাড়ছে, কারণ ….

সিলেটকে বলা হয় ‘দ্বিতীয় লন্ডন’। যুক্তরাজ্যে সিলেটি প্রবাসীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতির কারণে এই...

ওবায়দুল কাদের ও সাদ্দামসহ ৭ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি

জুলাই–আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান দমনে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আওয়ামী...

হাদি হত্যাচেষ্টা মামলায় শুটার ফয়সালের বাবা–মায়ের চাঞ্চল্যকর জবানবন্দি

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় নতুন...

পরবর্তী টার্গেট হাসনাত আব্দুল্লাহ ? ভারতীয় সাবেক কর্ণেলের পোস্ট ঘিরে উদ্বেগ

হাদির ওপর হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই এবার টার্গেট করা হয়েছে হাসনাত...