চাকরির লোভ দেখিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানোর অভিযোগে গঠিত এক ভয়াবহ মানবপাচারকারী চক্রের মূল হোতা মুহাম্মদ আলমগীর হোছাইনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বুধবার গভীর রাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। যুদ্ধে অংশ নিয়ে ইতিমধ্যে বাংলাদেশি কয়েকজন যুবক নিহত হয়েছেন, কেউ গুরুতর আহত, কেউবা পালিয়ে দেশে ফিরে পরিবারসহ চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
সিআইডি জানায়, আলমগীর হোছাইন নামে ৪০ বছর বয়সী এই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি নাগরিকদের আকর্ষণীয় বেতনে চকলেট কারখানায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী কিংবা বাবুর্চির চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাশিয়ায় পাঠিয়ে আসছিলেন। শুরুতে ওমরাহ ভিসার মাধ্যমে সৌদি আরব নিয়ে গিয়ে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার পর তাঁদের হস্তান্তর করা হতো রাশিয়ার এক ‘সুলতান’ নামধারী ব্যক্তির কাছে। সেখান থেকেই শুরু হতো বিভীষিকাময় অধ্যায়—যেখানে একজন সাধারণ চাকরিপ্রত্যাশী পরিণত হতেন একজন যুদ্ধবন্দি বা ‘জোরপূর্বক সৈনিক’-এ।
ভুক্তভোগীরা জানান, রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর তাঁদের আর কোনো চাকরির ব্যবস্থা হয়নি। বরং সেনা ক্যাম্পে রেখে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হয়। যারা যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, তাঁদের ওপর চলে ভয়াবহ নির্যাতন—খাবার বন্ধ, শারীরিক নিপীড়ন, একঘরে রাখা, এমনকি মানসিকভাবে ভেঙে ফেলার পাঁয়তারা। বাধ্য হয়ে তাঁরা অস্ত্র ধরেন। যুদ্ধের ময়দানে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত তিনজন বাংলাদেশি, যাঁদের একজন নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুমায়ুন কবির।
ঢাকার বনানী থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে আলমগীরকে। গতকাল তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জানা গেছে, আলমগীর ২০০৮ সালে রাশিয়ায় যান ছাত্র ভিসায়। পরে বিয়ে করে নাগরিকত্ব লাভ করেন এবং সেখানে থেকেই এই মানবপাচার চক্র পরিচালনা করতেন। সিআইডির ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি তিন ধরনের ভিসার মাধ্যমে অন্তত ৫০ জন বাংলাদেশিকে রাশিয়ায় পাঠান। তাদের মধ্যে গত এক বছরে ১১ জনকে সরাসরি যুদ্ধ শিবিরে নিয়োজিত করা হয়।
এই চক্রের সদস্যদের কেউ কেউ বাংলাদেশেই রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফাবিহা জেরিন ওরফে তামান্না নামে এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়, যিনি বনানীর ড্রিম হোম ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেডের অংশীদার। তিনিও এ চক্রের অন্যতম সংগঠক। জানা গেছে, যাঁরা সৌদি আরবে অবস্থান করছিলেন, যুদ্ধের বিষয়টি জানতে পেরে রাশিয়া যেতে রাজি হননি। ফলে তাঁদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছে, দেশে ফেরাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
চক্রের কবল থেকে পালিয়ে আসা একজন ভুক্তভোগী, নরসিংদীর পলাশ উপজেলার মো. আকরাম হোসেন, জানুয়ারিতে দেশে ফিরে বিষয়টি প্রকাশ্যে আনেন। তাঁর বক্তব্যের ভিত্তিতেই যুদ্ধাহত আমিনুলের স্ত্রী বনানী থানায় মামলা করেন। এরপরই তদন্তে নামে সিআইডি এবং একে একে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
সিআইডি প্রধান কার্যালয়ের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এই চক্রের সদস্যরা অত্যন্ত সংঘবদ্ধ এবং কৌশলী। রাশিয়ায় যুদ্ধরত বাংলাদেশিদের পরিবারগুলো এখন দুশ্চিন্তায় সময় পার করছে, কারণ তাঁদের প্রিয়জনদের জীবনের নিরাপত্তা অনিশ্চিত। ইতোমধ্যে রাশিয়া সরকার দুজন নিহত বাংলাদেশির লাশ ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য এই ঘটনা এক বড় ধরনের সতর্কবার্তা। বিদেশে চাকরি বা উচ্চ আয়ের প্রলোভনের আড়ালে কী ভয়ানক পরিণতি অপেক্ষা করতে পারে, তার বাস্তব উদাহরণ হয়ে উঠেছে আলমগীর হোছাইনের পরিচালিত এই মানবপাচার চক্র। সিআইডি জানিয়েছে, চক্রের বাকি সদস্যদের খুঁজে বের করতে দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা নেওয়া হবে। পাশাপাশি, যারা এখনও বিদেশে আটকা পড়েছেন, তাঁদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
Leave a comment