রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মার চরের গ্রামের ছেলে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম। বাবার দাফনের শোক ভুলে কাঁধে নিতে হয়েছে সংসারের দায়। সেই দায়েই তিনটি কোরবানির গরু নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিল রাজধানীর বছিলা পশুর হাটে। গত পাঁচ দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে গরু বিক্রির জন্য অপেক্ষা করছিল সে। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বিক্রি হয়েছে আরিফুলের সব গরু।
গত শনিবার রাতে ঢাকা আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান আরিফুলের বাবা কোহিনূর শেখ (৫৭)। এরপর রবিবার তার দাফন সম্পন্ন হয়। পরদিন সোমবার ভগ্নিপতি দুলাল হোসেনের সঙ্গে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় আরিফুল। তিনটি গরু নিয়ে বছিলা হাটে ওঠে।
কোহিনূর শেখ ছিলেন একজন নদীনির্ভর মানুষ। আবাদি জমি বিলীন হয়ে যাওয়ার পর পদ্মায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এ বছর চাষ করেছিলেন সাড়ে চার বিঘা জমিতে পেঁয়াজ, যা থেকে লোকসান হয়েছে প্রায় তিন লাখ টাকা। সবই ছিল ঋণের টাকা। সেই ঋণ শোধের একমাত্র ভরসা ছিল কোরবানির জন্য পালন করা তিনটি গরু।
বছিলা হাটে প্রতিদিন গরুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরিফুল। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে বিক্রি হয় তাদের শেষ গরুটি—দাম ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর আগে দুপুরে বিক্রি হয় দুটি গরু, দাম ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। মোট পাওয়া যায় ৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এই অর্থ দিয়েই বাবার ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করবেন তারা।
বাবা-ছেলের এই যাত্রা ছিল ভাগ্য বদলের আশা নিয়ে। আরিফুল যাওয়ার কথা ছিল বিমানবন্দরে, প্রবাসী খালাকে আনতে। আর বাবা গরু বিক্রি করে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু ভাগ্য নির্মম—টাঙ্গাইলে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের পেছনে সবজিবোঝাই আরেকটি ট্রাক ধাক্কা দেয়। কোহিনূর শেখ ট্রাকের ওপরে গরুর পাশে বসা ছিলেন। ধাক্কায় ছিটকে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
বাবার মৃত্যু যেন আরিফুলের শৈশবের শেষ টান দিল। যে বয়সে কাঁধে বই থাকার কথা, সে বয়সেই কাঁধে তুলেছে সংসারের বোঝা। বছিলা হাটের খোলা আকাশের নিচে গরু বিক্রির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকাই ছিল তার বাস্তবতা।
রাজশাহীর চর পলাশী ফতেপুর গ্রামে কোহিনূর শেখের টিনের ঘর আর মাছ ধরার নৌকাটি যেন এখন শুধুই স্মৃতি। নদীভাঙনের কবলে পড়ে কয়েকবার বসতভিটা হারানো পরিবারটি আবারও অনিশ্চয়তার মুখে। পাশে থাকা পদ্মা নদী যেকোনো মুহূর্তে বাড়িটিও কেড়ে নিতে পারে।
আরিফুলের মা হাফেজা বেগম স্বামীর শোক আর ভবিষ্যতের ভয় মিলিয়ে কণ্ঠ হারিয়ে ফেলেছেন। ভাঙা গলায় বলছিলেন, “আমার ব্যাটার এখন কী হইব? সে তো কিছুই জানে না। এই বয়সে সে কীভাবে সংসার চালাবে? আমিই বা কী করমু?”
এই একটি দুর্ঘটনা পুরো পরিবারটির জীবনের হিসাব-নিকাশই ওলটপালট করে দিয়েছে। এখন আর আরিফুলের জীবন স্কুলের সীমানায় আটকে নেই—সে এখন জীবনযুদ্ধে এক সাহসী সৈনিক।
Leave a comment