বাংলাদেশে সংঘটিত গুমের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততার বিষয়টি পুনরায় দৃঢ়ভাবে উঠে এসেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে। গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে প্রতিবেদনটি তুলে দেন তদন্ত কমিশনের সভাপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী।
‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনোসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি), কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি), এমনকি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)-এর ভূমিকা নিয়েও গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের শিকার ব্যক্তিরা, প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা প্রায়শই এসব ঘটনার জন্য পুলিশের বিভিন্ন শাখা এবং র্যাবের ওপর সরাসরি দায় চাপিয়েছেন। এ ছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নির্ধারিত কার্যপরিধির বাইরে গিয়ে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ চালানোর ঘটনা সাংবিধানিক সীমালঙ্ঘনের উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হয়।
কমিশনের বিশ্লেষণে উঠে আসে, ২০০৯ সালের পর থেকে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার প্রবণতা বাড়ে। বিরোধী দল, বিশেষত বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক দমন–পীড়ন চালানো হয়। ‘ক্রসফায়ার’ বা বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা নিয়মিত হয়ে ওঠে, যেখানে কোনো বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। এছাড়া হেফাজতে মারধর, বৈদ্যুতিক শক, পানিতে চুবিয়ে রাখাসহ নানা ধরণের নির্যাতনের অভিযোগও প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে।
র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরও ভয়াবহ। প্রতিষ্ঠার শুরুতে অপরাধ দমনকারী বাহিনী হিসেবে সুনাম অর্জন করলেও পরবর্তীতে তা এক ভয়ঙ্কর দমনযন্ত্রে পরিণত হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। শত শত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ জানিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে ২০২১ সালে র্যাব ও সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বিশেষভাবে সমালোচিত টিএফআই সেল নামে গোপন কেন্দ্রের কথাও উল্লেখ করা হয়, যেখানে দিনের পর দিন ধরে মানুষকে অন্ধকার কক্ষে আটক রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো।
কমিশনের অভিযোগ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সরকার পরিবর্তনের পর র্যাব নিজেদের অপরাধ ঢাকতে টিএফআই সেলের গঠন পরিবর্তন, নির্যাতন কক্ষ ধ্বংস এবং নজরদারি ক্যামেরা সরিয়ে নেওয়ার মতো পদক্ষেপ নেয়। এতে প্রমাণ নষ্ট করার একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) সম্পর্কেও কমিশন বলেছে, সংস্থাটি কোনো সংবিধানসম্মত আইনের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে না, যার ফলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এনএসআইকে রাজনৈতিক বিরোধীদের নজরদারি ও দমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। এনএসআইয়ের আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর কমিশন জোর দিয়েছে।
সিটিটিসির ক্ষেত্রেও অভিযোগ রয়েছে। সন্ত্রাস দমন ও আন্তদেশীয় অপরাধ মোকাবিলার দায়িত্বে নিয়োজিত এই ইউনিটের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, বেআইনিভাবে আটক এবং জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ রয়েছে। কমিশন বলেছে, সিটিটিসিও একই ধরনের দায়মুক্তির সুবিধা ভোগ করছে, যেমনটি র্যাব দীর্ঘদিন ধরে করে আসছিল।
সার্বিকভাবে, তদন্ত কমিশনের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যদি নিজ নিজ কর্তৃত্ব ও সীমারেখা অমান্য করে এমন অপতৎপরতা চালিয়ে যায়, তাহলে দেশে জবাবদিহির চর্চা, মানবাধিকার রক্ষা এবং আইনের শাসন সুসংহত করা সম্ভব নয়।
প্রতিবেদন শেষে কমিশন র্যাব বিলুপ্তিসহ প্রতিটি বাহিনীর কাঠামোগত সংস্কার, নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা, এবং সাংবিধানিক সীমার মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালনের সুপারিশ করে। কারণ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিরাপত্তা বাহিনীর কাজ হবে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভয় ও নিপীড়ন নয়।
Leave a comment