Home ইতিহাসের পাতা জিয়াউর রহমান: এক সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্রনায়কের উত্থান 
ইতিহাসের পাতা

জিয়াউর রহমান: এক সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্রনায়কের উত্থান 

Share
Share

ঢাকা, ৩০ মে ২০২৫: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম জিয়াউর রহমান, যিনি ছিলেন একাধারে মুক্তিযোদ্ধা, সফল সেনাপ্রধান এবং দেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি। সামরিক জীবন থেকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তার উত্থান এবং আকস্মিক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তার বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে। আজ তার প্রয়াণ দিবস, ৪৩ বছর আগে ১৯৮১ সালের এই দিনে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হয়েছিলেন।

জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়ার বাগবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম ছিল কমল। পিতা মনসুর রহমান ছিলেন রসায়নবিদ। শৈশবের কিছুটা সময় বগুড়ার গ্রামে এবং বাকিটা সময় কলকাতায় অতিবাহিত করেন। ভারত বিভাগের পর তার পিতা করাচিতে চলে গেলে জিয়া হেয়ার স্কুল ছেড়ে করাচি একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ১৯৫৫ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। সামরিক জীবনে তিনি একজন সুদক্ষ ছত্রীসেনা ও কমান্ডো হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি অসীম বীরত্বের পরিচয় দেন এবং ‘হিলাল-ই-জুরাত’ খেতাবে ভূষিত হন। ১৯৬০ সালে তিনি খালেদা খানমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের দুই সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালরাতের পর জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করেন এবং ২৭শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। যদিও শেখ মুজিবুর রহমান ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন এবং এম এ হান্নানসহ আরও কয়েকজন তার পূর্বে ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন, জিয়ার ঘোষণা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে।

স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ২৪শে আগস্ট তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে ৩রা নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানে তাকে গৃহবন্দী করা হলেও ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে তিনি মুক্ত হন এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল তিনি তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সরিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং ১৯৭৮ সালে সেনাবাহিনী থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে অবসর গ্রহণ করেন।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান দেশের রাজনীতিতে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন, যা অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। তার শাসনামলে তিনি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ছিল খাল খনন কর্মসূচি, গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন, এবং শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি। তিনি বেসরকারি খাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিত করেন এবং জনশক্তি রপ্তানি, তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্যসহ অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানির দ্বার উন্মোচন করেন। পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি সোভিয়েত ব্লক থেকে সরে এসে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উপর জোর দেন। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহায়তা সংস্থা (সার্ক) প্রতিষ্ঠায় তার উদ্যোগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

জিয়াউর রহমান অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন, কিন্তু তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে বিরোধীদের দমনের অভিযোগও ছিল। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে, চট্টগ্রামের স্থানীয় সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যকার বিরোধ নিরসনে তিনি চট্টগ্রাম সফরে যান এবং সেখানেই সার্কিট হাউজে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নির্মমভাবে নিহত হন। তার মৃত্যুর পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং জিয়াউর রহমানের মরদেহ চট্টগ্রামে গোপনে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে তার মরদেহ ঢাকায় এনে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে দাফন করা হয়। তার জানাজায় লাখো মানুষের ঢল নামে, যা তার জনপ্রিয়তার প্রমাণ। জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতা গ্রহণ করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এই হত্যাকাণ্ড ঘিরে আজও অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don't Miss

মুসলিম প্রধান দেশ মরক্কোতে ঈদুল আজহায় কোরবানি নিষিদ্ধ

মরক্কো সরকার ঈদুল আজহাকে ঘিরে দেশজুড়ে পশু কোরবানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় জনমনে দেখা দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া। বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদের রাজকীয়...

ঈদেও সামান্য মাংসের স্বাদ পাবে না গাজার অধিকাংশ মানুষ

গাজার আকাশে হয়তো চাঁদ উঠবে ঈদের আগমনী বার্তা নিয়ে, কিন্তু ভাঙা ঘর, খালি হাড়ি আর ক্ষুধার্ত মুখগুলোর কাছে সে বার্তা শুধুই এক অদৃশ্য...

Related Articles

শুক্রবার ও শনিবারকে সরকারি ছুটি ঘোষণা আওয়ামী লীগ সরকারের

১৯৯৭ সালের ৩০ মে, এই দিনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সরকারি...

জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পরের এক সপ্তাহে কী ঘটেছিল বাংলাদেশে?

১৯৮১ সালের ৩০শে মে ভোরে চট্টগ্রামের এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন বিএনপির...

উসমানীয়দের কনস্টানটিনোপল জয়: ১৫০০ বছরের রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি

আজ থেকে ৫৭১ বছর আগে, ১৪৫৩ সাল এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল যা...

টাইটানিক না অলিম্পিক? বিমা কেলেঙ্কারি ও ফেডারেল রিজার্ভ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

বিশ্বের অন্যতম আলোচিত ও হৃদয়বিদারক সমুদ্র দুর্ঘটনা টাইটানিক ডুবি নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে...