বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একসময় যিনি ছিলেন আলোচিত, প্রভাবশালী ও অবিসংবাদিত—সেই তোফায়েল আহমেদ আজ এক নিঃশব্দ বৃদ্ধ, সময়ের কাছে পরাভূত এক চরিত্র। শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন, ’৬৯-এর ছাত্র আন্দোলনের অগ্রনায়ক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও একাধিকবার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এই নেতাকে ঘিরে যেসব স্মৃতি একসময় মানুষকে উদ্দীপ্ত করত, আজ তা যেন কেবলই ইতিহাসের পৃষ্ঠা।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ছবি যেন রাজনৈতিক বাস্তবতার এক অসহায় দলিল। সেখানে দেখা যায়, বার্ধক্যে নুয়ে পড়া তোফায়েল আহমেদ এক কোণে বসে আছেন নিঃশব্দে। চোখে নেই আগের তেজ, মুখে নেই ভাষণের ধ্বনি—আছে কেবল নীরব ক্লান্তি। এই দৃশ্য যেন নিছক কোনো রাজনৈতিক নেতার শারীরিক দুর্বলতার ছবি নয়; এটি এক সময়ের শাসকের নিঃসঙ্গ পরিণতির বহিঃপ্রকাশ।
একসময় তিনি ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। দলীয় সভায় তার কণ্ঠে সিদ্ধান্ত হতো চূড়ান্ত, মন্ত্রীসভায় তার মতামত থাকত নির্ধারক। অথচ সেই নেতা আজ নিজ দলের দৃষ্টিতেও প্রায় বিস্মৃত। বর্তমান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। সময়ের পরিক্রমায় যিনি ছিলেন ভবিষ্যতের স্বপ্নদ্রষ্টা, তিনিই আজ হয়ে গেছেন অতীতের উপাখ্যান।
তোফায়েল আহমেদ এমন এক দলে ছিলেন, যারা এক সময় জনগণের আস্থার প্রতীক হলেও পরবর্তীতে হয়ে ওঠে ক্ষমতার প্রতিচ্ছবি। সেই ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয়করণ, দুর্নীতি এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতার দায় সকলের কাঁধে এসেছে। সময়ের কাছে এসবের কোনো মূল্য থাকে না। ক্ষমতার চেয়ারে বসে থেকেও যারা মানুষের পাশে থাকেননি, ইতিহাস তাদের বড় বেশি কঠোর চোখে দেখে।
সেই ছবি আমাদের সামনে প্রশ্ন তোলে—ক্ষমতা কি চিরস্থায়ী? একজন রাজনীতিকের শেষ পরিণতি কি এমনই হবে? যে মানুষটি কখনো লক্ষ মানুষের সামনে ভাষণ দিয়েছেন, তার শেষ দিনগুলো কেন কাটে নিঃসঙ্গতায়? এর উত্তর আমাদের খুঁজে নিতে হয় রাজনীতির কাঠামোর ভেতরে, নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার অভাবের ভেতরে।
তোফায়েল আহমেদ এখন কেবলই একটি নাম নয়—তিনি একটি শিক্ষা। তিনি প্রমাণ করেন, মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং ইতিহাসে টিকে থাকার জন্য শুধু পদমর্যাদা নয়, প্রয়োজন জনমানুষের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক। প্রয়োজন ছিল সাহসের সাথে সত্য বলার, নিজের অবস্থান থেকে জনগণের পক্ষে দাঁড়ানোর।
তার জীবনের এই পড়ন্ত অধ্যায় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—সময়ের কাছে কোনো পদমর্যাদা অমর নয়, কোনো ক্ষমতা স্থায়ী নয়। যা থাকে, তা হলো মানুষের মনে একজন নেতার আসন। আর সেই আসনে বসতে হলে দরকার হয় সততা, সহানুভূতি ও নিরলস জনসেবা।
এই ছবির ভাষা উচ্চকিত নয়, তবুও এর প্রভাব বজ্রনিনাদের চেয়েও গভীর। একদিন যারা এখন ক্ষমতায়, যারা ভাবছেন পদ আর ক্ষমতা তাদের চিরস্থায়ী সঙ্গী—তাদের প্রতিও এই ছবি ছুঁড়ে দেয় এক নিঃশব্দ প্রশ্ন: আপনি ইতিহাসে কী রেখে যাবেন?
Leave a comment