জীববিজ্ঞানে যুগান্তকারী এক আবিষ্কারে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউসিএসএফ) গবেষকরা ফুসফুসের এক নতুন ও বিস্ময়কর ভূমিকা চিহ্নিত করেছেন। ২০১৭ সালের ২২ মার্চ নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণায় তারা জানান, ইঁদুরের দেহে প্লেটলেট তৈরির প্রধান স্থান হিসেবে কাজ করছে ফুসফুস—যা এতদিন পর্যন্ত শুধু শ্বাসপ্রশ্বাসের অঙ্গ বলেই বিবেচিত ছিল।
এই গবেষণায় দেখা গেছে, একটি ইঁদুরের ফুসফুস প্রতি ঘণ্টায় ১ কোটির বেশি প্লেটলেট তৈরি করছে। এই সংখ্যা মোট দেহের প্রয়োজনীয় প্লেটলেটের অর্ধেকেরও বেশি। এতদিন চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, এসব রক্তকণিকা তৈরি হয় মূলত অস্থিমজ্জায়। কিন্তু নতুন এই গবেষণা সেই প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
ইউসিএসএফ-এর অধ্যাপক ও চিকিৎসক মার্ক আর. লুনি বলেন, “আমরা বুঝতে পারছি, ফুসফুস শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসে সাহায্য করে না—এটি রক্ত তৈরির কাজেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ।”
দুই-ফোটন ইন্ট্রাভাইভাল ইমেজিং নামে একটি উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে জীবিত ইঁদুরের ফুসফুসে রক্তকণিকার আচরণ পর্যবেক্ষণ করেন গবেষকরা। এই ইমেজিংয়ের সময় তাঁরা দেখেন, ফুসফুসের ভেতর রক্তনালিতে বিস্তর মেগাকারিওসাইট (প্লেটলেট উৎপাদক কোষ) অবস্থান করছে, যাদের ভূমিকা এতদিন তেমন গুরুত্ব পায়নি।
গবেষণার সহলেখক এমা লেফ্রঁসে জানান, “আমরা এই বিশালসংখ্যক মেগাকারিওসাইট ফুসফুসে দেখে অবাক হই। এরপরই বুঝি—এটা খুঁটিয়ে দেখা জরুরি।”
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, শুধু প্লেটলেটই নয়—ফুসফুসে রয়েছে রক্তের স্টেম সেল বা রক্তকোষ তৈরির পূর্বসূরি কোষও। একটি ইঁদুরের ফুসফুসে প্রায় ১০ লাখ এমন কোষ চিহ্নিত করা গেছে, যেগুলো অস্থিমজ্জার অভাব পূরণে রক্ত তৈরিতে সহায়তা করতে পারে।
এই ধারণা যাচাই করতে গবেষকরা একের পর এক ফুসফুস প্রতিস্থাপন করেন। দেখা যায়, যদি কোনো রোগাক্রান্ত ইঁদুরকে এমন একটি ফুসফুস প্রতিস্থাপন করা হয়, যাতে আগে থেকেই প্লেটলেট উৎপাদক কোষ থাকে, তবে তা কয়েক মাস ধরে স্বাভাবিক মাত্রায় প্লেটলেট তৈরি করতে পারে। এমনকি দেখা গেছে, এই কোষগুলো শরীরের অস্থিমজ্জায় পৌঁছে গিয়ে লোহিত রক্তকণিকা, টি সেল ও বি সেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা কোষও উৎপন্ন করতে সক্ষম।
গবেষকদের মতে, এই নতুন তথ্য থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া বা প্লেটলেট স্বল্পতা রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
গবেষণার সহলেখক গুয়াদালুপে ওর্তিজ-মুনোজ বলেন, “আমরা এখন বুঝতে পারি, প্লেটলেট উৎপাদনের জন্য ফুসফুস আদর্শ একটি জৈব-কারখানা। এটি হয়তো রক্তের প্রবাহজনিত বল বা অজানা কোনো রাসায়নিক সংকেতের জন্য কার্যকর।”
এই গবেষণার প্রেক্ষিতে এখন প্রশ্ন উঠেছে—যদি ফুসফুসে এত গুরুত্বপূর্ণ রক্তকোষ থাকে, তবে ফুসফুস প্রতিস্থাপনের সময় এসব কোষ নতুন দেহে কীভাবে কাজ করে? বা নতুন অঙ্গদানের প্রক্রিয়ায় এসব স্টেম সেল কী ভূমিকা রাখে?
গবেষণার উপসংহারে মার্ক লুনি বলেন, “আমাদের বোঝা উচিত—রক্তকোষ তৈরির স্টেম সেলগুলি হয়তো স্থির নয়, তারা দেহের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করতে পারে। হয়তো অন্যান্য অঙ্গেও তারা গিয়ে ‘বিদেশে পড়াশোনার’ মতো অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে।”
এই গবেষণা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় হার্ট, লাং ও ব্লাড ইনস্টিটিউটসহ (এনএইচএলবিআই) বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় পরিচালিত হয়। ইউনিভার্সিটি অব উটাহ মেডিকেল স্কুলের গাই জিমারম্যান গবেষণাটি পর্যালোচনা করে বলেন, “এটি শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে না—বরং প্লেটলেট রোগ, প্রদাহজনিত রোগ, ও অঙ্গপ্রতিস্থাপন সংক্রান্ত বহু প্রশ্নের উত্তর দেবে।”
এই গবেষণার প্রেক্ষিতে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে এখন স্পষ্ট—রক্ত তৈরির ক্ষেত্রে অস্থিমজ্জা একচ্ছত্র নয়, বরং ফুসফুস এক গুরুত্বপূর্ণ সহযোদ্ধা। মানবদেহের এই ‘শ্বাসপ্রশ্বাসের অঙ্গ’ আমাদের রক্ত ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অন্যতম মূল স্তম্ভ বলেই প্রমাণিত হতে যাচ্ছে।
Leave a comment