রাশিয়ার আগ্রাসনের সম্ভাব্য হুমকি মোকাবিলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে স্থায়ীভাবে সেনা মোতায়েন করেছে জার্মানি। লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে ৪৫তম ট্যাংক ব্রিগেড স্থাপন করে এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটি। এর মাধ্যমে ন্যাটোর পূর্ব সীমান্তে প্রতিরক্ষার দেয়াল আরও মজবুত হলো।
ভিলনিয়াসে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ইউনিটের যাত্রা ঘোষণা করেন জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎর্স এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্তোরিয়াস। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লিথুয়ানিয়া, জার্মানি ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা, যাদের হাতে ছিল তিন দেশের পতাকা। উদ্বোধনী আয়োজনে অংশ নেন জার্মান সেনাবাহিনীর সদস্যরাও।
৪ হাজার ৮০০ সেনা এবং ২০০ বেসামরিক কর্মী নিয়ে গঠিত নতুন এই ইউনিটের নাম ‘৪৫তম ট্যাংক ব্রিগেড’। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার এক বছর পর, ২০২৩ সালে ব্রিগেড গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৭ সালের মধ্যেই এটি পূর্ণ সক্ষমতা অর্জন করবে।
চ্যান্সেলর মেৎর্স এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমাদের বাল্টিক মিত্রদের নিরাপত্তা মানেই আমাদের নিরাপত্তা। আমরা যে কোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জোটের ভূখণ্ড রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।” রাশিয়ার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “তাদের সংস্কারবাদী আগ্রাসন শুধু ইউক্রেন নয়, সমগ্র ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।”
লিথুয়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট গিতানাস নাউসেদাও নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, “আমরা হুমকির প্রকৃতি বুঝি এবং আমাদের মিত্রদের সঙ্গে মিলেই এর মোকাবিলা করতে পারব বলে বিশ্বাস করি।” দেশটি আগামী বছর প্রতিরক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ ব্যয়ের পরিকল্পনা করছে, যা ন্যাটোর লক্ষ্য অনুযায়ী।
প্রসঙ্গত, লিথুয়ানিয়া একদিকে রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদ এক্সক্লেভ এবং অন্যদিকে রুশ মিত্র বেলারুশের সীমানা ঘেঁষা দেশ। মাত্র ২.৯ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশটির অনুরোধে জার্মানি স্থায়ী ব্রিগেড গঠন করেছে। প্রেসিডেন্ট নাউসেদা জার্মান সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “এই পদক্ষেপ শুধু লিথুয়ানিয়ার নয়, পুরো বাল্টিক অঞ্চলের প্রতিরক্ষা জোরদার করবে।”
জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্তোরিয়াস এই পদক্ষেপকে “সম্ভাব্য প্রতিপক্ষের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা” হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “জার্মানি ন্যাটোর এক ইঞ্চি ভূমিও রক্ষায় প্রস্তুত থাকবে।”
এদিকে, পর্যাপ্ত সেনা সদস্য নিয়োগে কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে জার্মানি। এ সমস্যা সমাধানে দেশটির পার্লামেন্ট ‘বুন্ডেস্টাগ’ নতুন আইন পাস করেছে, যাতে কর্মঘণ্টার নমনীয়তা, বাড়তি ভাতা ও ওভারটাইমের জন্য অতিরিক্ত পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
চ্যান্সেলর মেৎর্স, যিনি বুন্ডেসভেয়ারে কাজ করা প্রথম জার্মান চ্যান্সেলর, জানান, “আমরা ইউক্রেনের পাশে আছি। ইউরোপীয় হিসেবেও একত্রে থাকবো এবং যেখানেই সম্ভব, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করবো।”
২০২৩ সালে প্রাক্তন চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস ১০০ বিলিয়ন ইউরোর প্রতিরক্ষা তহবিল গঠন ও জিডিপির ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের ঘোষণা দিয়ে ‘সাইটেনবেন্ড’ নীতির সূচনা করেছিলেন। এবার মেৎর্স আরও এক ধাপ এগিয়ে জার্মান সংবিধানে থাকা ঋণসীমা শিথিল করে ২০৩২ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষায় জিডিপির ৫ শতাংশ ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। এর মধ্যে ৩.৫ শতাংশ সামরিক সরঞ্জাম ও ১.৫ শতাংশ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যবহৃত হবে।
মেৎর্স বলেন, “বহু বছরের অবহেলার পর আমি ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলব। আমাদের মিত্ররাও এটি আমাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে, বরং তারা কার্যত এটি দাবি করে।”
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রেসিডেন্টদের পরস্পরবিরোধী বার্তায় ইউরোপীয় মিত্রদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপের মিত্রদের প্রতিরক্ষা খাতে বেশি ব্যয়ের জন্য চাপ দিয়ে এসেছেন, বিশেষ করে জার্মানিকে।
এই প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে চ্যান্সেলর মেৎর্স বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপ থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে—এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো ইঙ্গিত নেই।”
জার্মানির এই পদক্ষেপ কেবল রাজনৈতিক বার্তা নয়, এটি ইউরোপে প্রতিরক্ষা ও ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের এক নতুন অধ্যায় রচনা করছে।
Leave a comment