১৮৯৯ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ, বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয় এক যুগান্তকারী কবি, যার কলমে দ্রোহ যেমন জ্বলে উঠেছে, তেমনি প্রবাহিত হয়েছে প্রেমের নিরবধি ধারাও। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম—বাংলা সাহিত্যের ‘বিদ্রোহী কবি’, জাতীয় চেতনায় প্রজ্জ্বলিত এক দীপ্ত নক্ষত্র। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এই কবির জীবন ছিল নানা চ্যালেঞ্জে পূর্ণ, কিন্তু তাঁর প্রতিভা ছিল অসাধারণ, বিপুল ও বর্ণময়।
শৈশবে দারিদ্র্য, বাবার অকালমৃত্যু ও সংসারের বোঝা টানতে গিয়ে কখনও লেটো গানের দলে, কখনও মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করেছেন নজরুল। কিন্তু এই সংগ্রামী জীবন তাঁকে দমাতে পারেনি। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে পেয়েছিলেন নতুন অভিজ্ঞতা, যা পরবর্তীতে তাঁর লেখায় উঠে এসেছে অসামান্য শক্তি ও সাহসে। ১৯১৯ সালের পর থেকে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন নিয়মিতভাবে এবং ১৯২২ সালে প্রকাশিত তাঁর কবিতা বিদ্রোহী তাঁকে এনে দেয় রাতারাতি খ্যাতি।
নজরুলের কবিতা, গান ও গদ্যে ফুটে উঠেছে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার এবং মানবতাবাদী চেতনার জয়গান। তিনি যখন বলেছিলেন, “আমি চির-বিদ্রোহী বীর”, তখন তা কেবল একটি কবির উচ্চারণ ছিল না—তা ছিল একটি যুগের দ্রোহের ঘোষণা।
তাঁর সাহিত্যকর্মে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন দার্শনিক প্রেক্ষাপটের সমন্বয় দেখা যায়। নজরুল ছিলেন জাতপাত, বর্ণবাদ ও ধর্মীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক আপসহীন কণ্ঠস্বর। “ধর্মের পথে কেউ যেন না হয় বিভ্রান্ত, মানবতার পথেই হোক সত্যের সন্ধান”—এই আদর্শেই তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন।
১৯৪২ সালে এক রহস্যজনক অসুস্থতা তাঁকে নীরব করে দেয়। এরপর জীবনের প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় তিনি বাকশক্তিহীন অবস্থায় কাটান। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সসম্মানে ঢাকায় নিয়ে আসে এবং ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দে এই মহাকবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। জাতীয় কবির মর্যাদা পাওয়া নজরুল এখন চিরনিদ্রায় শায়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে।
আজ তাঁর জন্মদিনে জাতি স্মরণ করছে সেই কবিকে, যিনি কেবল সাহিত্যিক নন, ছিলেন এক সত্যিকারের বিপ্লবী, এক স্বপ্নদ্রষ্টা। বাংলা সাহিত্যে প্রেম, মানবতা, সাম্য আর দ্রোহের মেলবন্ধন ঘটিয়ে যিনি গড়ে তুলেছিলেন এক অনন্য উচ্চতা—তিনি চিরকাল প্রাসঙ্গিক, চিরকাল আমাদের অনুপ্রেরণা।
Leave a comment