গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের ১৯ মাস অতিক্রম করেছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও ইসরায়েল তার প্রধান লক্ষ্য—হামাসসহ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের মূল ভীত গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়নি। বরং প্রতিরোধের ভাষা দিন দিন আরও জোরালো হচ্ছে। সংঘাতের শুরু থেকে পশ্চিমা শক্তিগুলোর নিঃশর্ত সমর্থন, স্থল-আকাশ-সমুদ্রপথে পূর্ণ অবরোধ—সবকিছু মিলিয়ে এক অপ্রতিরোধ্য অবস্থান তৈরি করলেও হামাসকে নিস্তেজ করতে পারেনি তেলআবিব।
সাম্প্রতিক হামলায় দেখা যাচ্ছে, হামাস কেবল বেঁচে নেই, বরং রণকৌশলগতভাবে চমকে দিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনীকে। গাজা সীমান্তের বেইত হানুনে সুড়ঙ্গপথে হামলা চালিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর সদস্যদের হতাহত করা, উদ্ধারকারী দলকে লক্ষ্য করে বিস্ফোরণ ঘটানো—এসব ইঙ্গিত দেয়, ফিলিস্তিনিরা এখনও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং হামলার সক্ষমতা রাখে। এমনকি যেসব অঞ্চলকে ইসরায়েল ‘নিরপেক্ষ’ বলেছে, সেখানেও প্রতিরোধ অব্যাহত রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে গাজা যুদ্ধের সঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধের তুলনা তীব্রভাবে সামনে আসছে। ভিয়েতনামে যেমন মার্কিন বাহিনী কৌশলগতভাবে প্রতিপক্ষের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও আদর্শগতভাবে সমাজের সঙ্গে যুক্ত প্রতিরোধ আন্দোলনকে দমন করতে পারেনি, গাজাতেও সেই বাস্তবতা প্রতিফলিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে একীভূত প্রতিরোধ আন্দোলনকে কেবল অস্ত্র দিয়ে দমন সম্ভব নয়—এটা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
ভেতর থেকে ইসরায়েল সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ফাটল স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একের পর এক ব্যর্থতার দায় অন্যদের ঘাড়ে চাপাতে ব্যস্ত। সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের সঙ্গে মতবিরোধ, গোয়েন্দা খাতে বিশৃঙ্খলা এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ—সব মিলিয়ে ইসরায়েল এখন নিজ ভূখণ্ডেই রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ইসরায়েল এখন গৃহযুদ্ধের কাছাকাছি অবস্থায় রয়েছে।
দ্য নিউ আরবের তথ্য অনুযায়ী, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরেও অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও গাজা যুদ্ধ ইসরায়েলের জন্য এক মারাত্মক বোঝা হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন গড়ে ২৬০ মিলিয়ন ডলার যুদ্ধ পরিচালনায় ব্যয় হচ্ছে। বিনিয়োগ কমেছে, পর্যটন খাত ধসে পড়েছে এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের মধ্যেও সমর্থন কমে এসেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত এই যুদ্ধ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি ইসরায়েলি পণ্যের ওপর শুল্ক কমানোর বিরোধিতা করেছেন এবং সংঘাত অবসানের আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রই প্রতিবছর ইসরায়েলকে প্রায় চার বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়ে থাকে।
সব মিলিয়ে এখন এটা স্পষ্ট যে, গাজা যুদ্ধ শুধু ইসরায়েলের সামরিক ব্যর্থতা নয়, বরং একটি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার নাম। বিশ্ব যা-ই বলুক, কিংবা ইসরায়েল তা মানুক বা না মানুক—গাজা এখন ইসরায়েলের ভিয়েতনাম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
– মেহমেত রাকিপওগ্লু
সহকারী অধ্যাপক, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, মারদিন আরতুকলু বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক
মূল নিবন্ধ: মিডলইস্ট আই
Leave a comment