দেশের চা–বাগানগুলোর নারী শ্রমিকদের এক বড় অংশ কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন—এমন চিত্র উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। গবেষণায় বলা হয়েছে, এসব নারী শ্রমিকের ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মস্থলে যৌন নির্যাতনের শিকার হন, যার মধ্যে ৩০ শতাংশ মৌখিক এবং ১৪ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের সম্মুখীন হন।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ‘নারী চা–শ্রমিকদের অধিকার, সেবাপ্রাপ্তিতে প্রবেশগম্যতা: বাস্তবতা ও আইনগত প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক গবেষণাটি পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা ইনোভেটিভ রিসার্চ অ্যান্ড কনসালট্যান্সি (আইআরসি)। অক্সফাম ইন বাংলাদেশের সহায়তায় এবং ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ সংগঠনের তত্ত্বাবধানে এই গবেষণাটি সিলেট বিভাগের তিনটি জেলার ১১টি উপজেলায় পরিচালিত হয়।
গবেষণায় উঠে এসেছে, ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ নারী শ্রমিক তাঁদের কর্মস্থলকে নিরাপদ মনে করেন না। এর পেছনে সহিংসতা, মালিকপক্ষের হুমকি, ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা, চুরি এবং অন্যান্য নানা কারণ ভূমিকা রাখছে। নারী শ্রমিকদের ১৬ দশমিক ১ শতাংশ সহিংসতা, ১২ দশমিক ৩ শতাংশ মালিকের হুমকি, ৮ দশমিক ২ শতাংশ ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা, ৪ দশমিক ১ শতাংশ চুরির আশঙ্কা এবং বাকিরা বিভিন্ন কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।
গবেষণায় অংশ নেওয়া ৩ শতাধিক নারী শ্রমিকের মধ্যে ২৩ জন তাঁদের অভিজ্ঞতা বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁদের মধ্যে ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ নারী অশ্লীল ভাষা বা অঙ্গভঙ্গির শিকার হয়েছেন, ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ, ২৬ দশমিক ১ শতাংশ যৌন হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের শিকার এবং ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ অন্যান্য ধরণের নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছেন।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, এসব নির্যাতন বা অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেন ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ নারী। তবে বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠরা নীরব থাকেন সামাজিক ও পারিবারিক চাপে অথবা প্রতিকার পাওয়ার আশার অভাবে।
উক্ত গবেষণায় আন্তর্জাতিক তুলনাও করা হয়েছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও কেনিয়ার চা–বাগানের নারী শ্রমিকদের জন্য প্রচলিত আইন ও সুবিধার তুলনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে বলা হয়েছে।
গবেষণায় নারী শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, মজুরিসংক্রান্ত বৈষম্য, বকেয়া মজুরি, বাসস্থানের সংকট, শিক্ষা, নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসেবার অভাবসহ নানামুখী সমস্যার কথাও উঠে আসে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নারীর নেতৃত্ব বাড়ানো, আইনি সহায়তা ও পরামর্শ প্রদান, সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, জোরপূর্বক উচ্ছেদ প্রতিরোধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং চা–বাগানে কর্মরত নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের সুপারিশও গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কেয়া খান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ এবং অক্সফাম ইন বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মাহমুদা সুলতানা প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, দেশের চা–বাগানভিত্তিক নারী শ্রমিকরা একদিকে যেমন অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন, অন্যদিকে তেমনই তারা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এ চিত্র পরিবর্তনে রাষ্ট্র, মালিকপক্ষ ও সুশীল সমাজের একত্রে কাজ করার আহ্বান জানান তাঁরা।
Leave a comment