ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের উত্তেজনা আবারও সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর প্রাণঘাতী সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতীয় বিমানবাহিনী মঙ্গলবার গভীর রাতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে একযোগে অন্তত নয়টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা চালায়। ভারতের দাবি, তারা নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জঙ্গি ঘাঁটিতে এই অভিযান চালিয়েছে।
মাত্র ২৫ মিনিট স্থায়ী এ অভিযানে বিস্ফোরণের তীব্র শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা, আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যায় বহু মানুষের। ইসলামাবাদ বলছে, ছয়টি স্থানে হামলা হয়েছে এবং তারা পাঁচটি যুদ্ধবিমান ও একটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে—যদিও দিল্লি এসব দাবি অস্বীকার করেছে।
এই ঘটনাকে ঘিরে চারটি বড় প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে: পাকিস্তান কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে, দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ কি অনিবার্য, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী ভূমিকা নেবে এবং পরিস্থিতি এখন কোন দিকে গড়াতে পারে?
পাকিস্তানের সরকারি সূত্র জানিয়েছে, ভারতীয় হামলায় ৩১ জন নিহত ও ৪৬ জন আহত হয়েছেন, বেশিরভাগই এলওসি বরাবর। পাল্টা দাবিতে ভারতও বলছে, পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে তাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৫ জন বেসামরিক নাগরিক। এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছে সংঘাতের শঙ্কা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারকার হামলা ব্যতিক্রমী। ভারতের লক্ষ্যবস্তু ছিল পাকিস্তানভিত্তিক তিনটি প্রধান সন্ত্রাসী সংগঠন—লস্কর-ই-তৈয়্যেবা, জইশ-ই-মোহাম্মদ ও হিজবুল মুজাহিদিনের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। এমনকি পাকিস্তানের ভেতরে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের বাহাওয়ালপুর ও মুরিদকেতেও হামলা হয়েছে, যেখানে এসব গোষ্ঠীর সদর দপ্তর ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে বলে দাবি দিল্লির।
দিল্লির ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বলছেন, এবার ভারতের কৌশল ছিল আরও বিস্তৃত এবং ভৌগোলিকভাবে গভীরে প্রবেশকারী। তিনি বলেন, “এটি কেবল প্রতিক্রিয়ামূলক পদক্ষেপ নয়, বরং এটি ভারতের নতুন কৌশলগত বার্তা—যা সীমান্ত ছাড়িয়ে পাকিস্তানের ভেতরে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টার প্রতিফলন।”
ভারতে পাকিস্তানের সাবেক হাইকমিশনার অজয় বিসারিয়া বলেন, এটি “বালাকোট প্লাস” ধাঁচের অভিযান। এর মাধ্যমে ভারত দেখাতে চেয়েছে, তারা কেবল প্রতিশোধ নয়, বরং নির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক, দৃশ্যমান এবং সামরিক সক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কৌশল নিচ্ছে।
তবে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। লাহোরভিত্তিক বিশ্লেষক ইজাজ হুসেন মনে করেন, পাকিস্তানের জবাব আসা অনিবার্য এবং তা সীমিত ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বা পাল্টা সামরিক অভিযানের আকার নিতে পারে। একই মত প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের আলবানি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি। তিনি বলেন, “যদি পাকিস্তান চুপ করে থাকে, তাহলে এটি ভারতের ভবিষ্যৎ হামলার বৈধতা হয়ে দাঁড়াবে।”
তবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এই জবাবদিহিতাকে জটিল করে তুলেছে। জনপ্রিয় নেতা ইমরান খানের গ্রেপ্তার, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জনরোষ এবং রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে পাকিস্তানে যুদ্ধোন্মাদনার পরিবেশ তৈরি হয়নি। বিশ্লেষক উমর ফারুক বলেন, “এটা সেনাবাহিনীর জন্য একটি সুযোগ—জনসমর্থন পুনরুদ্ধার এবং অভ্যন্তরীণ সমালোচনা ঠেকাতে সীমান্তে শক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো।”
ইতিমধ্যেই পাকিস্তানি গণমাধ্যমে যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও এসব দাবি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা প্রয়োজন, তথাপি এসব প্রচারণা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখছে।
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে যাবে কি না, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, বিষয়টি কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। আবার কেউ বলছেন, যদি পাল্টাপাল্টি হামলা অব্যাহত থাকে, তাহলে পরিস্থিতি ২০০২ সালের পর সবচেয়ে গুরুতর সংকটে রূপ নিতে পারে।
একই ধরনের ঘটনা ২০১৯ সালে বালাকোটে ভারতীয় বিমান হামলার পর ঘটেছিল, যেখানে পাকিস্তানের পাল্টা হামলা ও একজন ভারতীয় বৈমানিককে আটক করে উত্তেজনা চরমে নিয়ে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত কূটনৈতিক উদ্যোগেই উত্তেজনা হ্রাস পেয়েছিল।
এবারও দুই দেশের কাছে কূটনীতিই হতে পারে উত্তেজনা প্রশমনের একমাত্র পথ। ভারতের সর্বশেষ পদক্ষেপগুলো যেমন কূটনৈতিক বহিষ্কার, ভিসা স্থগিতকরণ ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা, তেমনি পাকিস্তানের পাল্টা প্রতিক্রিয়াও সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে।
সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে এই স্নায়ুযুদ্ধময় পরিস্থিতি এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বিশ্ববাসী তাকিয়ে আছে, পাকিস্তানের পরবর্তী পদক্ষেপে এই সংকট কোন দিকে মোড় নেয়।
Leave a comment