বাঙালি জাতীয়তাবাদ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অনন্য ও জটিল অধ্যায়, যা আত্মপরিচয়, ভাষা, সংস্কৃতি এবং ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। এই জাতীয়তাবাদের শেকড় গাঁথা বাংলার হাজার বছরের ইতিহাসে, যা কেবল একটি ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশই নয়, বরং একটি অসাম্প্রদায়িক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ জাতি গঠনের স্বপ্নও বহন করে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা ঘটে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের সময়কালে। নবজাগরণের যুগে বাংলা হয়ে ওঠে ভারতবর্ষে আধুনিক শিক্ষার, সাহিত্য–সংস্কৃতির, সমাজ সংস্কারের এবং রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রস্থল। রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন বোস, কাজী নজরুলসহ অনেক মনীষী বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও মানবিক চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটান। তখন থেকেই বাঙালির মধ্যে আত্ম–অস্তিত্ব এবং ভাষাগত গৌরবের চেতনা গড়ে ওঠে।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল। ব্রিটিশের বিভাজন নীতির বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে একটি অখণ্ড ও ঐক্যবদ্ধ বাংলার দাবিতে সাধারণ মানুষ। এই ঘটনাই পরবর্তীকালে স্বদেশী আন্দোলন, বিপ্লবী সংগ্রাম এবং একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উত্থানের পথ সুগম করে তোলে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরবর্তী উত্থান ঘটে ১৯৪৭–পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানে। এখানকার বাঙালিরা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের উর্দুভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন কেবল ভাষার জন্য রক্তদান নয়, ছিল সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার এক তীব্র অভিব্যক্তি। ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ আজও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত।
এরই ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। “জয় বাংলা” স্লোগানে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালিরা এক গণআন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করে। জাতির এই মুক্তি ছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি আত্মপরিচয়ের পুনরুদ্ধার।
তবে বাংলাদেশের জন্মের পর রাজনৈতিক মতভেদ ও নতুন জাতীয়তাবাদের ধারায় বিভাজন ঘটে। জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” মূলত ভূখণ্ড–ভিত্তিক একটি পরিচয় তুলে ধরলেও, সমালোচকেরা একে বাঙালি সংস্কৃতি থেকে সরে যাওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখে থাকেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর–পূর্বে বসবাসকারী বাঙালিরাও বঞ্চনা, ভাষা সংকট ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে চলেছে। “বাংলা পক্ষ“, “জাতীয় বাংলা সম্মেলন” প্রভৃতি সংগঠন সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ, হিন্দি আগ্রাসনের বিরোধিতা ও বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার। এই আন্দোলনগুলো কেবল ভাষার অধিকারের প্রশ্নই নয়, বরং এক প্রকার সাংস্কৃতিক আত্মরক্ষার লড়াই।
সমসাময়িক সময়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং একটি চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি, যা বৈশ্বিক পর্যায়েও মাতৃভাষার অধিকার, সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং জাতিগত মর্যাদার প্রশ্নে মুখর। ভাষা, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের এ সংগ্রাম আজও বাঙালিকে এক সূত্রে গাঁথে এবং তাকে মনে করিয়ে দেয়: “আমি বাঙালি, বাংলা আমার অধিকার।”
Leave a comment