দেশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধীরা। তারা মানুষকে জিম্মি করে, অস্ত্র ঠেকিয়ে, গুলি করে অথবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতাবোধ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
সর্বশেষ গত রোববার রাতে রাজধানীর বনশ্রীতে বাসায় ফেরার সময় এক সোনা ব্যবসায়ীকে গুলি ও কুপিয়ে জখম করে স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এ ঘটনার ভিডিও চিত্র ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
শুধু বনশ্রীর ঘটনাই নয়, বিগত কয়েক মাসে একের পর এক অপরাধের ঘটনা সামনে এসেছে। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিক কালে ডাকাতি ও দস্যুতার (ছিনতাই) ঘটনায় মামলা বেড়েছে। গত জানুয়ারিতে দেশে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪২টি, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ৬৯ শতাংশ বেশি। ডিসেম্বর মাসে এই সংখ্যা ছিল ২৩০, যা আগের বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি।
সব মিলিয়ে গত আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১,১৪৫টি, যা ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় ৩৮২টি বেশি (৫০ শতাংশ)।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানো এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো। যদিও রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল করতে পেরেছে সরকার, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, নতুন প্রশাসনের অধীনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো স্বাভাবিক কার্যক্রমে পুরোপুরি ফিরে আসতে পারেনি। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোয় নতুন পুলিশ সদস্যদের পদায়ন করা হয়েছে, যারা অপরাধীদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য জানে না। অপরাধীদের ধরতে পুলিশের সোর্স কমে গেছে, ফলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারছে না, ফলে অপরাধীরা মনে করছে তারা পার পেয়ে যাবে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, অভিযানে গেলে পুলিশের ওপর হামলার আশঙ্কা থাকে, আবার বলপ্রয়োগ করলে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। তাই পুলিশের কার্যক্রম তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে।
বিশ্লেষক ও পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক সংকট ও বেকারত্বও অপরাধ বৃদ্ধির একটি কারণ। কাজের সুযোগ কমে যাওয়ায় অনেকেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
এলাকাভেদে অপরাধ প্রবণতাও ভিন্ন। মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি ও হাজারীবাগে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে, অন্যদিকে গুলিস্তান ও যাত্রাবাড়ীতে পেশাদার ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেশি। উত্তরায় কিশোর গ্যাং সক্রিয়, আর খিলগাঁও, মগবাজার, বাড্ডা ও মহাখালীতে মৌসুমি অপরাধীদের তৎপরতা বেশি।
ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু পেজ ও আইডি থেকে ধর্ষণ, ছিনতাই ও ডাকাতির বিষয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পুরোনো ভিডিও ছড়িয়ে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। পুলিশের মতে, অপরাধের প্রকৃত চিত্র বোঝার জন্য সত্যিকারের তথ্যের ওপর নির্ভর করা জরুরি।
১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী একটি বাসে ডাকাতি ও শ্লীলতাহানির ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দেয়। এরপর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই ও ডাকাতির ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এর জেরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে।
সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য বিশেষ টহল ও অভিযান পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম জানান, র্যাব, এটিইউ ও ডিএমপি সমন্বিতভাবে বিস্তৃত টহল কার্যক্রম চালাবে।
আগামী মাসে রমজান ও ঈদুল ফিতরের কারণে অর্থনৈতিক লেনদেন বাড়বে, যা চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, অন্যথায় ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে। সরকারকে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হতে হবে।
Leave a comment