বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বিশেষত কবিতা ও সংগীতে অনন্য অবদান রাখা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন। তাঁর এই নাগরিকত্ব লাভ শুধু আনুষ্ঠানিকতার বিষয় ছিল না, এটি ছিল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এক মহান কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধার প্রকাশ।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তাঁর কবিতা, গান, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবতা এবং সাম্যের বার্তা বহন করেছে। তাঁর লেখনীতে যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছে, তা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
যদিও নজরুলের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে, তবে তাঁর সৃষ্টিশীলতা, আদর্শ এবং সংগ্রামের চেতনা বাংলাদেশের মানুষের অন্তরে চিরস্থায়ী আসন গেড়ে নিয়েছে। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর নাগরিকত্ব প্রদান ছিল সময়ের দাবির মতোই।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে আনা হয়। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া কবি তখন অসুস্থ ছিলেন, বাকশক্তি হারিয়েছিলেন এবং স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। তবুও বাংলাদেশ সরকার তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে।
ঢাকায় নিয়ে আসার পর ধানমন্ডির ২৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে তাঁকে রাখা হয় এবং পরবর্তীতে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে স্থানান্তর করা হয়। একই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জাতীয় কবির স্বীকৃতি দেয় এবং ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে।
বাংলাদেশের প্রতি নজরুলের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি দিতে ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ সালে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। এটি ছিল এক প্রতীকী ও আবেগঘন মুহূর্ত, যেখানে বাংলাদেশ নজরুলকে আপন করে নিল চিরদিনের জন্য।
এই সময় নজরুলের শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না, তবে তাঁর নাগরিকত্ব লাভের বিষয়টি ছিল জাতির জন্য গর্বের বিষয়। এর কয়েক মাস পর, একই বছরের ২৯ আগস্ট, তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়—যা ছিল তাঁর জন্য সর্বোচ্চ সম্মানের প্রতীক।
নজরুল শুধু একজন কবি নন, তিনি ছিলেন বিদ্রোহ, মানবতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও স্বাধীনতার প্রতীক। তাঁর নাগরিকত্ব প্রদান ছিল কেবল আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নয়, বরং এটি ছিল এক মহান কবির প্রতি জাতির ভালোবাসার প্রকাশ।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নজরুলের প্রভাব ব্যাপক। তাঁর লেখা গান, কবিতা এবং সাহিত্যকর্ম বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এখনো করছে।
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬, বাংলাদেশের জন্য এক গৌরবময় দিন। এই দিনে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিজের আপন জন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। নজরুলের কবিতা ও আদর্শ আজও বাঙালির চেতনায় জীবন্ত, আর তাঁর নাগরিকত্ব লাভ ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে।
Leave a comment