১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯—বাংলাদেশের ইতিহাসে এক শোকাবহ দিন। এই দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের আগে ছাত্রদের রক্ষার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দেওয়া এই অকুতোভয় শিক্ষক বাংলাদেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
১৯৬৯ সাল—বাংলাদেশ তখনো পূর্ব পাকিস্তান, কিন্তু গণমানুষের হৃদয়ে স্বাধীনতার চেতনা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছিল। সারাদেশ জুড়ে ছাত্র আন্দোলন চলছিল, যার মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের পর দেশের ছাত্র-জনতা ফুঁসে ওঠে। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান, যার নেতৃত্বে ছিল ছাত্রসমাজ।
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, রাজশাহীতে ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশ গুলি চালায়, যাতে একজন ছাত্র নিহত হন। এই হত্যার প্রতিবাদে ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তীব্র বিক্ষোভ শুরু করে। আন্দোলন দমাতে ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে সেনাবাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়।
সেদিন ছাত্ররা প্রতিবাদ জানাতে ক্যাম্পাসের বাইরে সমবেত হলে পাকিস্তানি সেনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে আসে। ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ আসার মুহূর্তেই সামনে এসে দাঁড়ান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। সেনাদের উদ্দেশে তিনি বলেন,
“আগে আমাকে গুলি করুন, তারপর ছাত্রদের ওপর গুলি চালাবেন!”
এই সাহসী উচ্চারণই ছিল তাঁর জীবনের শেষ কথা। সেনাবাহিনী তাঁর কথা উপেক্ষা করে এবং তাঁকে গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তিনি সেখানেই শহীদ হন।
অধ্যাপক শামসুজ্জোহার এই আত্মত্যাগ সারা দেশকে নাড়িয়ে দেয়। শিক্ষকের রক্তে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে ছাত্র ও সাধারণ মানুষের আন্দোলন। এই ঘটনার মাত্র দুই দিন পর, ১৯ ফেব্রুয়ারি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল বন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি সরকার। এর ঠিক একদিন পর ২১ ফেব্রুয়ারি, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ক্ষমতা ছাড়ার ঘোষণা দেন।
অধ্যাপক শামসুজ্জোহার শাহাদাত শুধু ছাত্র রাজনীতিতে নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পথপরিক্রমায়ও গভীর ছাপ ফেলে। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে শিক্ষাবিদদের হত্যা করে, কিন্তু সেই ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক শামসুজ্জোহার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে।
শহীদ শামসুজ্জোহার স্মরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। ১৮ ফেব্রুয়ারিকে ‘শিক্ষক দিবস’ ঘোষণা করা হয়েছে, যা তাঁর আত্মত্যাগের প্রতি জাতির সম্মান ও কৃতজ্ঞতার প্রতীক। কিন্তু তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা হবে শিক্ষাক্ষেত্রে ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো।
অধ্যাপক শামসুজ্জোহা শুধু একজন শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন ন্যায়, সাহস, এবং মানবতার প্রতীক। তাঁর জীবন ও আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এক সত্যনিষ্ঠ মানুষ কীভাবে ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে পারেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে তাঁর নাম চিরস্মরণীয় থাকবে, আর তাঁর রক্তের ঋণ শোধ করা সম্ভব একমাত্র মুক্ত, সুশিক্ষিত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে।
Leave a comment