আমরা সবাই জানি, ফেব্রুয়ারি মাস সাধারণত ২৮ দিনে শেষ হয়, আর লিপ ইয়ার হলে একদিন বাড়িয়ে ২৯ দিনে পরিণত হয়। তবে যদি বলা হয়, ইতিহাসে একবার সত্যিই ৩০শে ফেব্রুয়ারি ছিল—আপনি কি বিশ্বাস করবেন? অবিশ্বাস্য মনে হলেও, একবারের জন্য হলেও এই তারিখটি ক্যালেন্ডারে যুক্ত হয়েছিল।
কিন্তু কীভাবে এমনটা সম্ভব হলো? কেনই বা এক মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে একদিন বেশি যোগ করা হয়েছিল? এই অদ্ভুত ঘটনাটি মূলত ঘটেছিল ১৭১২ সালে সুইডেনে, এবং পরে ১৯৩০-৩১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে।
ক্যালেন্ডারের বিবর্তন ও লিপ ইয়ারের আবির্ভাব
একটি বছর সাধারণত ৩৬৫ দিনে সম্পন্ন হয়। তবে আসলে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরতে নেয় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড। এই অতিরিক্ত সময়ের কারণে প্রতি চার বছর পর পর একদিন যোগ করে লিপ ইয়ার ধরা হয়, যাতে ক্যালেন্ডার সৌর বর্ষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
প্রাচীন রোমানরা প্রথম ক্যালেন্ডার ব্যবস্থায় এই সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন। জুলিয়াস সিজার ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করেন, যেখানে প্রতি চার বছর পর পর ফেব্রুয়ারিতে একদিন বাড়িয়ে ২৯ দিন করা হয়। পরে ১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগরি ত্রয়োদশ এই ক্যালেন্ডারে কিছু সংশোধন আনেন এবং আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রচলন শুরু হয়।
কিন্তু সুইডেন এই ক্যালেন্ডার পরিবর্তনের মধ্যবর্তী একটি ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির শিকার হয়, যা ইতিহাসে ৩০শে ফেব্রুয়ারি সৃষ্টির একমাত্র উদাহরণ।
কীভাবে সুইডেন ক্যালেন্ডারে ৩০শে ফেব্রুয়ারি এল?
১৭০০ সালে সুইডেন সিদ্ধান্ত নেয় জুলিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন করবে। তবে তারা একবারে পরিবর্তন না করে, ধীরে ধীরে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরিকল্পনা ছিল, ১৭০০ থেকে ১৭৪০ সালের মধ্যে তারা লিপ ইয়ারগুলো বাদ দেবে, যাতে ধাপে ধাপে তারা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
তবে সমস্যাটা হয় যখন ১৭০৪ ও ১৭০৮ সালে সুইডেন ভুল করে লিপ ইয়ার হিসেবে ২৯শে ফেব্রুয়ারি পালন করে ফেলে। ফলে তাদের ক্যালেন্ডার জুলিয়ান বা গ্রেগরিয়ান, কোনো ক্যালেন্ডারের সাথেই মিলছিল না!
পরিস্থিতি সামাল দিতে, সুইডিশ রাজা দ্বাদশ চার্লস ১৭১২ সালে একটি ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি আদেশ দেন, সুইডেন আবার জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ফিরে যাবে এবং এই কারণে ১৭১২ সালে ফেব্রুয়ারিতে শুধু ২৯ ও ২৮শে ফেব্রুয়ারি নয়, বরং ৩০শে ফেব্রুয়ারিও যোগ করা হবে!
ফলাফল? ওই বছর সুইডেনের ক্যালেন্ডারে ৩০শে ফেব্রুয়ারি দেখা যায়—ইতিহাসে একমাত্র সময় যখন প্রকৃতপক্ষে এই তারিখটি বিদ্যমান ছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ৩০শে ফেব্রুয়ারি
এই ঘটনা আবারও সামনে আসে ১৯৩০-৩১ সালে, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ক্যালেন্ডারে একটি চরম সংস্কার আনে।
সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন তখন সিদ্ধান্ত নেন যে, সপ্তাহের ধারণাকে নতুনভাবে সাজাতে হবে। তাদের নতুন বিপ্লবী ক্যালেন্ডারে বছরকে ১২ মাসের পরিবর্তে সমান ৩০ দিনের মাসে ভাগ করা হয়, যাতে প্রতিটি মাসে নির্দিষ্ট কাজের দিন নিশ্চিত করা যায় এবং উৎপাদন বাড়ানো যায়।
ফলে ক্যালেন্ডারে ৩০শে ফেব্রুয়ারিও যুক্ত করা হয়। যদিও এটি বাস্তবে ব্যবহৃত হয়নি এবং এই ক্যালেন্ডার পরবর্তীতে পরিত্যক্ত হয়, তবু এটি ইতিহাসে ৩০শে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয়বারের মতো আবির্ভাব ঘটায়।
৩০শে ফেব্রুয়ারির রহস্য ও কল্পনার জগতে এর ব্যবহার
বাস্তব ক্যালেন্ডারে ৩০শে ফেব্রুয়ারির অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী হলেও, এটি কল্পকাহিনীতে জায়গা করে নিয়েছে।
• বিখ্যাত লেখক রে ব্র্যাডবিউরির ছোটগল্প “দ্য লাস্ট নাইট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড”-এ ৩০শে ফেব্রুয়ারির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে এই দিনটি এক রহস্যময় ঘটনার পূর্বাভাস দেয়।
• জনপ্রিয় ফ্যান্টাসি লেখক জে. আর. আর. টলকিয়েন তার ‘দ্য হবিট এবং দ্য লর্ড অফ দ্য রিংস’ সিরিজে হবিটদের ক্যালেন্ডারে ৩০শে ফেব্রুয়ারি রাখেন।
• বাস্তব জগতে, অনেক সময় অজানা মৃত্যুর তারিখ বা ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য ৩০শে ফেব্রুয়ারি ব্যবহার করা হয়েছে।
আজকের দিনে ৩০শে ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু ইতিহাসে একবারের জন্য হলেও এই তারিখটি বাস্তবে বিদ্যমান ছিল। ক্যালেন্ডার পরিবর্তনের জটিলতার কারণে সুইডেন ১৭১২ সালে এটি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল, এবং পরে সোভিয়েত ইউনিয়নও পরীক্ষামূলকভাবে এটি ব্যবহার করেছিল।
তবে বর্তমান গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৩০শে ফেব্রুয়ারির কোনো স্থান নেই। তাই প্রতি চার বছর পর যখন আমরা ২৯শে ফেব্রুয়ারি দেখি, তখন মনে রাখা উচিত—এই দিনটিরও একদিন দীর্ঘতর এক অতীত ছিল!
Leave a comment