প্রতিটি দিনই আমাদের ইতিহাসের অংশ, যেখানে সময়ের পরতে পরতে রচিত হয় নতুন নতুন ঘটনা। ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসেও নানা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক ঘটনা ঘটেছে, যা আমাদের বর্তমানকে গঠনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এই দিনে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা আমাদের জাতীয় চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে, কূটনৈতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে গেছে এবং শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে ১৭ ফেব্রুয়ারি পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ আরও সুসংগঠিত হয় এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে এই দিনটি আবারও বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, কারণ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পরবর্তীতে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতাকে সুসংহত করেছে। একইভাবে ১৯৭৩ সালের এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মুসলিম দেশগুলোর বৃহত্তম সংস্থা ওআইসিতে (Organization of Islamic Cooperation) যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়, যা আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করে।
১৯৮৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এরশাদ সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ ঢাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, যা পরবর্তীতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে রায়ের দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ চলতে থাকে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে গণআন্দোলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়েছে।
সংস্কৃতি ও ক্রীড়াক্ষেত্রেও ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো একটি আনুষ্ঠানিক বইমেলার আয়োজন করা হয়, যা পরবর্তীতে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ রূপে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়, যা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এছাড়া, ২০১৫ সালে বিশ্বকাপে আফগানিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশ দল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও ১৭ ফেব্রুয়ারি নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা উন্নয়নের জন্য ‘বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের গবেষণা খাতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যা ২০১৮ সালে বাস্তবে রূপ নেয় এবং দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়নে এক বিশাল অর্জন হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এছাড়া, ১৭ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। ১৯৩১ সালে জন্ম নেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, যিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক উজ্জ্বল দিকপাল হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৬৪ সালে জন্ম নেন বিশিষ্ট লেখিকা নাসরীন জাহান, যিনি তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে পাঠকহৃদয়ে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন। এই দিনে বিদায় নিয়েছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও গবেষণাক্ষেত্রের অন্যতম কৃতী সন্তান ড. জামাল নজরুল ইসলাম, যিনি মহাবিশ্বের গঠন ও গণিতবিদ্যায় অসামান্য অবদান রেখেছেন।
১৭ ফেব্রুয়ারি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্ব ইতিহাসের দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ। এদিন বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সচেতনতা দিবস পালিত হয়, যা মানবাধিকারের লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি দিনই আমাদের জন্য শিক্ষণীয় এবং ১৭ ফেব্রুয়ারিও তার ব্যতিক্রম নয়। এদিনের ঘটনাগুলো আমাদের জাতীয় গর্ব, সংগ্রাম, অর্জন ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে চেনার সুযোগ করে দেয়। ইতিহাসের এই শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যৎকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে সহায়তা করবে।
Leave a comment