ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে তদন্তে একের পর এক নতুন ও চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসছে। সর্বশেষ অনুসন্ধানে মূল অভিযুক্ত ফয়সাল করিম মাসুদের পরিচয় নিয়ে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। পুলিশি তদন্তে জানা গেছে, এই শুটার একসময় শোবিজ অঙ্গনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, যা মামলাটিকে আরও জটিল ও বহুমাত্রিক করে তুলেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কয়েকটি ছবিতে দেখা যায়, ফয়সাল করিম মাসুদ একটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তিনি ২০২২ সালে নির্মিত ‘কিলার’ শিরোনামের একটি নাটকে অংশ নেন। এই তথ্য প্রকাশের পর সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়—একজন পেশাদার শুটার কীভাবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
এরই মধ্যে হত্যাকাণ্ডের আর্থিক যোগসূত্র খতিয়ে দেখতে গিয়ে আরও গুরুতর তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সংস্থাটির দাবি, ফয়সাল করিম মাসুদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব বিশ্লেষণ করে ১২৭ কোটি টাকার বেশি অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব লেনদেনের ধরন ও পরিমাণ স্বাভাবিক আর্থিক কার্যক্রমের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা।
রোববার (২১ ডিসেম্বর) সিআইডির এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন সংস্থাটির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আবু তালেব। তিনি জানান, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য সমন্বয় করে এই আর্থিক অনিয়মের চিত্র পাওয়া গেছে। এর ভিত্তিতে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ অনুযায়ী ফয়সাল করিম মাসুদসহ তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পৃথক অর্থপাচার অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে।
সিআইডির ভাষ্য অনুযায়ী, ফয়সাল করিম মাসুদ যিনি দাউদ খান ও রাহুল নামেও পরিচিত, এখনও গ্রেপ্তার না হলেও তাকে পলাতক থাকতে সহায়তা এবং মামলার আলামত গোপনের অভিযোগে তার পরিবারের সদস্যসহ একাধিক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযানের সময় বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব চেকের মাধ্যমে চূড়ান্ত লেনদেন সম্পন্ন হলে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়াত প্রায় ২১৮ কোটি টাকা, যা তদন্তকারীদের সন্দেহ আরও গভীর করেছে।
অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আবু তালেব বলেন, অভিযুক্তদের ব্যাংক হিসাবে থাকা প্রায় ৬৫ লাখ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার জন্য আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব অর্থ কোথা থেকে এসেছে এবং কারা এর পেছনে জড়িত—তা নির্ধারণে আর্থিক নথিপত্র, ব্যাংক রেকর্ড ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভূমিকা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, হাদি হত্যাকাণ্ডটি কেবল একটি বিচ্ছিন্ন হামলা নয়; এর পেছনে সুপরিকল্পিত অর্থায়ন, অস্ত্র সরবরাহ এবং লজিস্টিক সহায়তার একটি সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক সক্রিয় ছিল কি না, তা এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক লেনদেন ও বিদেশি সংযোগও তদন্তের আওতায় আনা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তারা।
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স-কালভার্ট রোডে দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হন শরিফ ওসমান হাদি। প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ১৫ ডিসেম্বর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়।
পরবর্তীতে মরদেহ দেশে আনা হলে ঢাকায় জানাজা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির নিকট তাকে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে শোক ও ক্ষোভের পাশাপাশি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জোরালো হয়েছে।
Leave a comment