বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যে কয়টি নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল, তার অন্যতম একটি হলো ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রির পর যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এটি কেবল একটি বেতার কেন্দ্রই ছিল না—এটি হয়ে উঠেছিল একটি প্রেরণার উৎস, একটি প্রতিরোধের ভাষা, একটি গণমাধ্যমের বিদ্রোহ।
২৫ মার্চ রাতে যখন ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চালিয়ে নির্বিচারে গণহত্যা চালায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে, তখন দেশজুড়ে নেমে আসে আতঙ্ক ও অন্ধকার। ঠিক এই সময়েই চট্টগ্রামে শুরু হয় প্রতিরোধের প্রথম প্রচেষ্টা—চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ২৬ মার্চ আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এ ঘোষণাই পরিণত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনার মূলমন্ত্রে।
তৎকালীন চট্টগ্রাম বেতারের কিছু সাহসী কর্মী এবং সংস্কৃতিমনা নাগরিকদের উদ্যোগে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে শুরু হয় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ নামে স্বাধীন সম্প্রচার। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে প্রথম ঘোষণায় বলা হয়, “এটি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।” এর একদিন পর, ২৭ মার্চ রাতে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে ঘোষণা দেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই ঘোষণাই আক্ষরিক অর্থে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রথম কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়।
তবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বোমা হামলার কারণে ৩০ মার্চ কালুরঘাট কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। কর্মীরা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পটিয়া, রামগড়, বাগফা ও শেষমেশ আগরতলার দিকে রওনা হন। প্রতিকূলতা, সীমাবদ্ধ প্রযুক্তি এবং অনিরাপদ পরিবেশ সত্ত্বেও তারা একটি পোর্টেবল ট্রান্সমিটার দিয়ে পুনরায় সম্প্রচার শুরু করেন। ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পর ভারতের সহায়তায় একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার পেয়ে ২৫ মে থেকে কলকাতার বালিগঞ্জে শুরু হয় নিয়মিত সম্প্রচার।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল শুধু ঘোষণার জায়গা নয়—এটি ছিল সাহস, সংস্কৃতি এবং সংবাদের এক মিলনস্থল। এখানে প্রতিদিন চলত ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু, যুদ্ধক্ষেত্রের সর্বশেষ সংবাদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগীত, চরমপত্রের তীক্ষ্ণ বিদ্রূপাত্মক কথিকা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির মাধ্যমে জাতিকে উজ্জীবিত করার এক বিশাল আয়োজন।
এই কেন্দ্রে একত্রিত হয়েছিলেন শিল্পী, কলাকুশলী, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, নাট্যকার ও সংগীত পরিচালকসহ প্রায় শতাধিক মানুষ, যাঁদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল: দেশের মানুষকে সাহস ও সত্য তথ্য পৌঁছে দেওয়া। যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শামসুল হুদা চৌধুরী, আলী যাকের, সমর দাশ, সিকান্দার আবু জাফর, নির্মলেন্দু গুণ, ফকির আলমগীর, রফিকুল আলমসহ আরও অনেকে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠস্বর, যেখানে যুদ্ধ হয়েছিল শব্দের মাধ্যমে। বুলেটের পাশাপাশি এই বেতারের শব্দ ছিল মুক্তিযোদ্ধার আত্মার শক্তি। এটি একটি বেতার কেন্দ্র নয়, একটি চেতনার কেন্দ্র।
আজকের প্রজন্মের জন্য এটি শুধু ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়—এটি স্মরণ করার মতো এক গৌরবময় সংগ্রামের দলিল। সেই সংগ্রাম, যেখানে মাইক্রোফোন ছিল অস্ত্র, কণ্ঠ ছিল যুদ্ধের শ্লোগান, আর প্রতিটি ঘোষণায় বাজতো বিজয়ের আগমনী সুর।
Leave a comment