রাজশাহীর তানোর উপজেলায় পরিত্যক্ত একটি গভীর নলকূপের গর্তে পড়ে দুই বছরের শিশু সাজিদের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় বিচার ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে তার পরিবার। এ ঘটনায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দায়িত্বশীলদের বিরুদ্ধে ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে সারাদেশে অরক্ষিত নলকূপগুলো বন্ধে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।
রোববার (১৪ ডিসেম্বর) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মনিরুল ইসলাম মিয়া এই লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। নোটিশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা ও প্রশাসনিক উদাসীনতাকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একটি শিশুর মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়; বরং দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও নজরদারির ঘাটতির করুণ পরিণতি।
লিগ্যাল নোটিশে উল্লেখ করা হয়, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় বরেন্দ্র অঞ্চলে শত শত পরিত্যক্ত ও অরক্ষিত নলকূপ রয়েছে, যেগুলো সাধারণ মানুষের জন্য নীরব কিন্তু মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। এসব নলকূপের অনেকগুলোই দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, কিন্তু সেগুলো সিল করা বা ভরাট করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
নোটিশে সাজিদের মৃত্যুর ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে বলা হয়, সম্প্রতি রাজশাহীর তানোর উপজেলার কোয়েলহাট পূর্ব পাড়া গ্রামে খেলতে গিয়ে শিশু সাজিদ একটি পরিত্যক্ত গভীর নলকূপে পড়ে যায়। দীর্ঘ উদ্ধার প্রচেষ্টার পরও তাকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এই মর্মান্তিক ঘটনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে চরম অবহেলা ও গাফিলতির স্পষ্ট প্রমাণ বলে উল্লেখ করা হয়।
আইনজীবীর পাঠানো নোটিশে সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। নোটিশে বলা হয়, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দায়িত্ব হলো জনগণের জীবন সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কিন্তু পরিত্যক্ত ও অরক্ষিত নলকূপগুলো বন্ধে ব্যর্থ হয়ে কর্তৃপক্ষ কার্যত ওই সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে।
লিগ্যাল নোটিশে ১৫ দিনের মধ্যে একাধিক নির্দেশনা বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়েছে। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে—রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের সব পরিত্যক্ত নলকূপ চিহ্নিত করে জরিপ পরিচালনা, রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে সেগুলো সিল করা বা ভরাট করে স্থায়ীভাবে বন্ধ করা, অবৈধভাবে নলকূপ খননে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ, নিরাপদ নলকূপ ব্যবস্থাপনায় মানসম্মত কার্যপ্রণালি (SOP) প্রণয়ন এবং অননুমোদিত নলকূপ স্থাপন রোধে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করা।
এ ছাড়া দায়িত্বে অবহেলাকারী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানানো হয়েছে। নোটিশে স্পষ্ট করে বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসব দাবি বাস্তবায়ন না হলে বিষয়টি জনস্বার্থ মামলা (পিআইএল) হিসেবে হাইকোর্ট ডিভিশনে দায়ের করা হবে।
সাজিদের পরিবার বলছে, তারা শুধু ক্ষতিপূরণই নয়, বরং ভবিষ্যতে যেন আর কোনো শিশুকে এমন মৃত্যুর মুখে পড়তে না হয়, সেই নিশ্চয়তা চান। পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, একটি ছোট শিশুর জীবন এভাবে ঝরে যাওয়ার পেছনে যারা দায়ী, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
এ ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও বরেন্দ্র অঞ্চলের অরক্ষিত নলকূপগুলোকে ‘মৃত্যুকূপ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এসব নলকূপ যে কতটা ভয়ংকর, তা তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, একাধিকবার সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মানবাধিকার ও আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই লিগ্যাল নোটিশ কেবল একটি ঘটনার বিচার চাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি বৃহত্তর জননিরাপত্তা ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে। তাদের মতে, রাষ্ট্রীয় সংস্থার অবহেলা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে এটি ভবিষ্যতে প্রশাসনিক জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির হতে পারে।
এদিকে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
Leave a comment