সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলায় নতুন করে আলোচনায় এসেছেন মামলার অন্যতম আসামি তানভীর রহমান। মামলার তদন্তে নিযুক্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সম্প্রতি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের অনুমতি চেয়েছিল। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সে আবেদন মঞ্জুর করে তদন্তে নতুন এক দিক উন্মোচনের পথ সুগম করলেন।
তানভীর রহমান এই মামলায় আগেই সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর দীর্ঘ সময় আলোচনার বাইরে থাকলেও এবার তদন্তে তাঁর সংশ্লিষ্টতা আরও ঘনীভূত হয়েছে। পিবিআইয়ের আবেদনে বলা হয়, নিহত সাংবাদিক মেহেরুন রুনির সঙ্গে তানভীরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, যা তদন্তের একাধিক স্তরে উঠে এসেছে। হত্যাকাণ্ডের আগের দিন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের সামনে তাঁদের সাক্ষাৎ ও ঘোরাঘুরির বিষয়টি তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সন্দেহের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।
২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রুনির সঙ্গে দেখা করে তানভীর তাঁকে নিজের গাড়িতে করে ঘুরতে নিয়ে যান এবং সন্ধ্যার দিকে রুনিকে তাঁর বাসায় নামিয়ে দেন বলে দাবি করা হচ্ছে। এরপর সেই রাতেই ঘটে যায় সাংবাদিক দম্পতির নৃশংস হত্যাকাণ্ড। কিন্তু পরদিন সকালে এমন ভয়াবহ সংবাদ জানার পরও তানভীর রহমান নিহতদের বাসায় বা জানাজায় উপস্থিত হননি এবং তাঁদের পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগও করেননি—এমন তথ্য আদালতের কাছে উপস্থাপন করেছে পিবিআই।
তদন্ত সংস্থাটি বিশ্বাস করে, তানভীরকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে হত্যার পেছনের মোটিভ ও খুনিদের পরিচয় উন্মোচিত হতে পারে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আজিজুল হক জানিয়েছেন, তাঁরা ইতিমধ্যে ৭০ থেকে ৮০ জন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন এবং প্রতিটি সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন।
প্রসঙ্গত, সাগর-রুনি হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে এখন পর্যন্ত মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, আবু সাঈদ, মিন্টু, কামরুল ওরফে অরুণ, এনামুল, পলাশ রুদ্র পাল এবং তানভীর রহমান। এদের মধ্যে কয়েকজন জামিনে মুক্ত হলেও একজন এখনো অন্য মামলায় কারাবন্দী রয়েছেন।
এই মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া প্রায় এক যুগ পার করে ফেললেও এখনও পর্যন্ত দায়ীদের শনাক্ত কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি করা সম্ভব হয়নি। তদন্তের দায়িত্ব একাধিক সংস্থার হাতে বদল হলেও রহস্যের জট আর খুলে না। প্রথমে শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ, পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), এরপর র্যাব এবং সর্বশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয় পিবিআইকে। তদন্তের দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়াও বারবার আদালতের হস্তক্ষেপে বাধ্যতামূলক হয়েছে।
র্যাবের অধীনে তদন্ত চলাকালে ১১২ বার প্রতিবেদন জমার সময় পেছানো হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালে একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা পড়ে। তখন জানানো হয়, নিহত দম্পতির ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে এবং ঘটনাস্থলে থাকা ডিএনএ নমুনা যুক্তরাষ্ট্রের ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। সে রিপোর্টে দুই অজ্ঞাত পুরুষের উপস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
২০২৪ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চার সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে, যা বর্তমানে মামলার তদন্ত কার্যক্রম তদারকি করছে। তবে পিবিআই প্রধান ও টাস্কফোর্সের প্রধান মো. মোস্তফা কামালের ভাষ্য মতে, এখনও এমন কোনো তথ্য মেলেনি যা দিয়ে হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ রহস্য উন্মোচিত হয়।
স্মরণযোগ্য যে, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে নিজেদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। এই জোড়া হত্যাকাণ্ড শুধু সাংবাদিক সমাজ নয়, পুরো জাতিকেই স্তম্ভিত করেছিল। আজ ১৩ বছর পার হলেও বিচার ও প্রকৃত রহস্য উন্মোচনের অপেক্ষা রয়ে গেছে আগের জায়গাতেই।
তানভীর রহমানকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদে নতুন কোনো তথ্য উদঘাটিত হয় কি না, তা এখন সময়ই বলে দেবে।
Leave a comment