পুরনো একটি সাইকেল কিনতে ৩ হাজার টাকার জন্য খালার বাসা রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় এসেছিল ১৫ বছরের এক কিশোর। কিন্তু খালার কাছে না চেয়ে নিজেই টাকা সরাতে গিয়ে ধরা পড়লে দুই খালাকে হত্যা করে পালিয়ে যায় সে।
তিন দিন আগে শুক্রবার পশ্চিম শেওড়াপাড়া থেকে মরিয়ম বেগম (৬০) ও সুফিয়া বেগম (৫২) নামে দুই নারীর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তাদের আরেক বোনের ছেলেকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদের পর এমন তথ্য দিয়েছে পুলিশ।
ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সোমবার সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পর সেই বাসার সিসিটিভি ভিডিও বিশ্লেষণ করে এক কিশোরকে শনাক্ত করা হয়। একপর্যায়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে সে।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ বলছে, মরিয়ম ও সুফিয়া যেদিন খুন হন, সেদিন তাদের বাসা বাইরে থেকে তালা দেওয়া ছিল। দুপুর ১২টা ৪৭ মিনিটে ব্যাগসহ ওই কিশোর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর বেলা ১টা ৫৭ মিনিটে আরেক পোশাকে সে বের হয়ে যায়।
এরপর পুলিশ ছেলেটিকে ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করে। তাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
ডিবি কর্মকর্তা নাসিরুল ইসলাম বলেন, ছেলেটির ‘অস্বাভাবিক আচরণ’ তাদের নজরে আসে। সে পুলিশের কার্যক্রমের ওপর বিশেষ নজর রাখছিল। পুলিশ কখন কোথায় যাচ্ছে, কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন, কী আলামত সংগ্রহ করছে, সেসব দিকে বিশেষ দৃষ্টি ছিল তার। “অর্থাৎ আমাদের টিম যেখানে যায়, সেখানে পাশে গিয়ে দাঁড়ায় (কিশোরটি)। আমাদেরকে বিভিন্ন নম্বর দিয়ে সহায়তা করার প্রবণতা ছিল তার মধ্যে।”
ছেলেটি তার দুই খালার জানাজায় অংশ নিতে ঝালকাঠি গিয়েছিল। তার অবস্থান শনাক্ত করে সেখান থেকে তাকে তার বাবার সঙ্গে নিয়ে আসার কথা বলেন নাসিরুল ইসলাম।
হ্ত্যাকাণ্ডের কারণ ও ঘটনার বর্ণনায় ডিবির যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল বলেন, “একটি পুরনো সাইকেল কেনার জন্য টাকা সংগ্রহে সে খালার বাসায় যায়। সাইকেলের দাম ৩ হাজার টাকা। শুক্র, শনি ও রোববার স্কুল বন্ধ থাকায় কাপড়-চোপড়সহ খালার বাসায় যায়।
“তার বড় খালা মরিয়ম জানতে চায়, একা এসেছে নাকি সঙ্গে তার মা এসেছে। তখন সে জানায় মা পরে আসবে। এরপর তাকে আপ্যায়নের জন্য ডাইনিং রুমে ছুরি দিয়ে লেবু কেটে শরবত তৈরি করছিলেন মরিয়ম। আরেক খালা রান্নাঘরে হাড়ি-পাতিল পরিষ্কার করছিলেন। এই ফাঁকেই ছেলেটি লিভিং রুমে ঢুকে সেখান থেকে খালার মানিব্যাগ থেকে টাকা চুরি করছিল।”
পুলিশ বলছে, বড় খালা মরিয়ম চুরির ঘটনাটি দেখে ফেলে। বিষয়টি তার মাকে বলে দেওয়ার কথা বললে সে ক্ষিপ্ত হয়ে ডাইনিংয়ের টেবিলে রাখা ছুরি দিয়ে খালা মরিয়মকে কয়েকবার আঘাত করে। চিৎকার শুনে আরেক খালা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলে তাকে ছুরিকাঘাত করে। এরপর রান্নাঘর থেকে শিল-পাটা এনে তাদের মাথায় আঘাত করে।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, “হত্যার পর কাপড়চোপড় পাল্টে ছেলেটি বাসা তালা দিয়ে বের হয়ে যায়। শনির আখড়া যাওয়ার জন্য অটোরিকশায় ওঠে। পথে বাসার চাবি ও তার পরিহিত ক্যাপ ফেলে দেয়। শনির আখড়া এলাকায় ইস্টার্ন শপিংমলের তিন তলায় মসজিদের ওয়াশরুমে গিয়ে ভেন্টিলেটর দিয়ে রক্তমাখা জামাকাপড় ফেলে দেয়। আর বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে তার স্যান্ডেলও ফেলে দেয়।”
সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি কর্মকর্তা নাসিরুল বলেন, “এলাকায় ছেলেটির বন্ধু খুব কম। তার বাবা ‘পাগলা’ বলে ডাকার কারণে একবার বাবাকে বটি নিয়ে ধাওয়া করেছিল। এ ছাড়া পারফরম্যান্স না থাকার কারণে দনিয়ার (যাত্রাবাড়ী) একটি স্কুল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় আমরা তার বাবাকে সঙ্গেই এনেছিলাম। তিনি বিআইডব্লিউটির একজন কর্মকর্তা। পরে তিনি চলে যান। মাদকাসক্তের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।”
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মরিয়ম বেগমের মেয়ে নুসরাত জাহান মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেন । সোমবার ওই মামলায় আদালতে হাজির করা হলে ছেলেটি দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের মিরপুর জোনাল টিমের এসআই কফিল উদ্দিন তার জবানবন্দি রেকর্ডের আবেদন করেন। পরে ঢাকার মহানগর হাকিম মনিরুল ইসলাম জবানবন্দি রেকর্ড করে গাজীপুরের টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দেন।
উল্লেখ্য, শুক্রবার মরিয়ম ও সুফিয়ার লাশ পাওয়া যায় পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ৬৪৯ নম্বর বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সহকারী পরিচালক মরিয়ম ২০২১ সালে অবসরে যান। তার স্বামী কাজী আলাউদ্দিনও বনবিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, যিনি বেশিরভাগ সময় বরিশালে গ্রামের বাড়িতে থাকেন।
মরিয়মের বড় মেয়ে ইসরাত জাহান খুসবু থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। আর ছোট মেয়ে নুসরাত জাহান বৃষ্টি ঢাকায় একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করেন। অপরদিকে নিহত সুফিয়া অবিবাহিত ও মানসিকভাবে কিছুটা ‘অস্বাভাবিক’ ছিলেন। বোন মরিয়মের বাসায় থাকতেন তিনি।
Leave a comment