একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সঙ্গে ‘জ্ঞান’ আর ‘সভ্যতা’ শব্দ দুটি যেভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, সেভাবেই জড়িয়ে থাকা উচিত তার প্রতিটি ছাত্রের চারিত্রিক মুল্যবোধ ও মানবিক গুণাবলির সঙ্গে। কিন্তু ঈদের প্রাক্কালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া এক মর্মান্তিক ও নিষ্ঠুর ঘটনা এ সকল বোধকে যেন প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নিজের সহপাঠীদের হাতে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী। নির্যাতনের এই নির্মম কাহিনি কোনো নাটক নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা, যা রীতিমতো কাঁপিয়ে দিয়েছে দেশের বিবেকবান মানুষকে।
ঐ শিক্ষার্থীকে রিকাবিবাজারের এক কনসার্টে যাওয়ার কথা বলে পরিকল্পিতভাবে ফাঁদে ফেলা হয়। অভিযুক্ত দুই শিক্ষার্থী—সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শান্ত তারা আদনান ও স্বাগত দাস পার্থ—তাকে কৌশলে অচেতন করে তাদের মেসে নিয়ে যায়। এরপর সারারাত ধরে তাকে আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়। ভিকটিম যখন সকালে জ্ঞান ফিরে পান, তখন নিজেকে ভয়াবহ অবস্থায় অভিযুক্তদের কক্ষে আবিষ্কার করেন। এরপর অভিযুক্তরা জানিয়ে দেয়, তারা তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করেছে এবং সেই সময়ের ভিডিও ধারণ করেছে, যা পরে ব্ল্যাকমেইলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তাকে মানসিকভাবে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
অপরাধীরা যেন এখানেই থেমে থাকেনি। ভিডিও ও নগ্ন ছবি প্রকাশের ভয় দেখিয়ে দিনের পর দিন ওই শিক্ষার্থীকে মানসিকভাবে হয়রানি করা হতে থাকে। আতঙ্কে, হতাশায়, অবসাদে ক্লান্ত মেয়েটি ধীরে ধীরে একাকীত্বে ডুবে যায়। কিন্তু নীরবতার মধ্যে যখন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে উঠছিল তার প্রতিটি মুহূর্ত, তখন সাহস করে কিছু বন্ধু ও সহপাঠীর সঙ্গে ঘটনার বিস্তারিত শেয়ার করে। তখনই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে এবং একে একে খবর পৌঁছে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল ছাত্রনেতা ও প্রশাসনের কাছে।
ঘটনার বিস্তারিত জানার পর সংশ্লিষ্টরা সঙ্গে সঙ্গে প্রক্টর অধ্যাপক মোঃ মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির আওতায় দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের আশ্বাস দেন। অতঃপর ভিকটিমের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে, প্রক্টরিয়াল বডির উদ্যোগে ও পুলিশের সহায়তায় মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্ত দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর সাত ঘণ্টার মাথায় কোতোয়ালি থানায় দায়ের হয় একটি ফৌজদারি মামলা।
এই ঘটনার দ্রুত এবং কার্যকর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি ও সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। একইসাথে সোচ্চার হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে সচেতন ছাত্রছাত্রীরা। তারা এ ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে বলেছেন, “ভবিষ্যতে যেন আর কেউ এমন ন্যাক্কারজনক অপরাধ করার সাহস না পায়।”
ঘটনাটি শুধু একটি অপরাধ নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়গামী নারীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্নকেও ঘিরে তুলেছে ভয়াবহ সংকেত। সমাজে শিক্ষিত শ্রেণি হিসেবে বিবেচিত যারা, তারাই যদি একে অপরের প্রতি এমন অমানবিক আচরণ করে, তাহলে সামাজিক নৈতিকতা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে, শুধুমাত্র অভিযুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করাই নয়, বরং ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিরোধে একটি কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য নিরাপত্তা কাঠামো তৈরি করা। নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সহপাঠীদের দায়বদ্ধতা ও সহমর্মিতার জায়গা নিশ্চিত করাও এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণ ও ব্ল্যাকমেইলের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর হলেও, বাস্তবায়নের দুর্বলতা অনেক সময় অপরাধীদের সাহস জোগায়। এই ঘটনার দ্রুত বিচার ও সর্বোচ্চ সাজা হওয়া উচিত যাতে তা ভবিষ্যতের দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সমাজ তখনই সভ্য, যখন সেখানে নারীর প্রতি সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
এই ভয়ঙ্কর ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন, এবং যেভাবে একযোগে সহযোগিতা করেছেন ভিকটিমকে সাহস দিতে—তা যেমন আশার আলো জাগায়, তেমনি এও প্রমাণ করে যে সামাজিক ন্যায়বিচার তখনই আসে, যখন কেউ চুপ না থেকে সাহসিকতার সঙ্গে দাঁড়ায়।
Leave a comment