যা সংবাদমাধ্যমে নেই, তা বাস্তবতাও নয়—একথা অনেকটা অতিরঞ্জিত শোনালেও বাস্তবে এর সত্যতা অস্বীকার করা কঠিন। মিডিয়া আমাদের চারপাশের ঘটনা কীভাবে দেখবে, কীভাবে ব্যাখ্যা করবে এবং কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে, তা নির্ধারণের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো এজেন্ডা সেটিং তত্ত্ব। এই তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে যে গণমাধ্যম কীভাবে জনগণের চিন্তা ও আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, সংবাদমাধ্যম যেসব ইস্যুকে অধিক প্রচার দেয়, সেসব ইস্যুই মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
১৯৭২ সালে গবেষক ম্যাক-কম্বস ও শ’র (McCombs & Shaw) গবেষণার মাধ্যমে এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা দেখান যে সংবাদমাধ্যম কোনো বিষয়ে আলোচনার কাঠামো তৈরি করতে পারে এবং জনগণ সেই কাঠামোর ভেতর থেকেই বিষয়টিকে মূল্যায়ন করে। সংবাদমাধ্যম সরাসরি আমাদের কী ভাবতে হবে তা বলে না, তবে তারা আমাদের বলে দেয়—কোন বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমেও এজেন্ডা সেটিং তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ লক্ষ করা যায়।
২০২০ সালে বাংলাদেশে একাধিক ধর্ষণের ঘটনা গণমাধ্যমে আলোচিত হয়। বিশেষ করে, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে গৃহবধূ নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে মূলধারার গণমাধ্যম এ ঘটনাকে বড় ইস্যু হিসেবে প্রচার করতে থাকে। টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদপত্র ও অনলাইন মিডিয়া ধারাবাহিকভাবে এই বিষয়ে সংবাদ প্রচার করে, যার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। গণমাধ্যমের প্রচারের ফলে দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান সংশোধন করে। এটি এজেন্ডা সেটিং তত্ত্বের একটি কার্যকর উদাহরণ, যেখানে গণমাধ্যম জনগণের আলোচনার বিষয় নির্ধারণ করেছে এবং নীতিনির্ধারণেও ভূমিকা রেখেছে।
পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছে। যখন বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্প থেকে অর্থায়ন প্রত্যাহার করে, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়—এটি হবে বাংলাদেশিদের আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক। সংবাদমাধ্যমও সেই ভাষ্যকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে এবং জাতীয় উন্নয়নের গল্প হিসেবে বিষয়টি জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলস্বরূপ, পদ্মা সেতু শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প নয়, বরং এটি দেশের সক্ষমতার প্রতীক হয়ে ওঠে। সংবাদমাধ্যমের প্রচারণার কারণেই এটি জনগণের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রধান উদ্বেগের কারণ। যখনই কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, তখন সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন করে এবং টকশো আয়োজন করে। ফলে জনগণের দৃষ্টিতে এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়, যাতে তারা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়।
যদিও গণমাধ্যম জনমত গঠনে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে, তবে অনেক সময় সংবাদমাধ্যম নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থে ইস্যু নির্বাচন করে। রাজনৈতিক দল বা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে এজেন্ডা নির্ধারণ করা হয়, যা জনগণের প্রকৃত ইস্যুকে আড়াল করতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থানের ফলে এজেন্ডা সেটিং ক্ষমতা শুধু মূলধারার গণমাধ্যমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এখন এটি অনেকাংশে জনগণও নির্ধারণ করতে পারে।
এজেন্ডা সেটিং তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে সংবাদমাধ্যম কেবল ঘটনা উপস্থাপন করে না, বরং তারা কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে, তা নির্ধারণ করতেও ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, পদ্মা সেতুর উন্নয়ন বার্তা এবং দ্রব্যমূল্যের ইস্যু—এসবই প্রমাণ করে যে গণমাধ্যম আমাদের চিন্তার কাঠামো গড়ে দেয়। তাই, নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো মিডিয়ার উপস্থাপনাকে বিশ্লেষণ করা, যাতে আমরা শুধু প্রচারিত এজেন্ডার শিকার না হয়ে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকতে পারি।
Leave a comment