শেখ হাসিনা সরকারের আমলে স্থানীয় ঠিকাদারদের মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ টাকার কাজ পেয়েছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে প্রতিষ্ঠানটি একের পর এক প্রকল্প বাগিয়ে নেয়। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে একচেটিয়া দরপত্র পাওয়ার কারণে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের উত্থান ঘটে।
২০১১ সালে মাত্র ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার ছোট ছোট নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করত ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার, যার মানও ছিল নিম্নমানের। তবে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও মির্জা আজমের প্রত্যক্ষ সহায়তায়, দরপত্রে ১৫ নম্বরে থেকেও ম্যাক্স ২০৯ কোটি টাকার চিনকি আস্তানা থেকে আশুগঞ্জ রিনিউয়াল রেল প্রকল্পের কাজ পেয়ে যায়।
প্রকল্পটি পেতেও নানা জালিয়াতি করে ম্যাক্স। মাত্র ১৬ কোটি টাকার একটি কাজের সঙ্গে আরও দুটি চলমান প্রকল্প (৫০ ও ৯৬ কোটি টাকার) যোগ্যতা হিসেবে দেখিয়ে দরপত্রে অংশগ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানটি। মন্ত্রীর সুপারিশে প্রকল্পটি তাদের হাতে চলে আসে। এই একক সাফল্যের পর, একের পর এক বড় বড় প্রকল্প তাদের হাতে আসতে থাকে।
গত ১৫ বছরে উন্নয়ন খাতে কমপক্ষে ৬০ হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। বর্তমানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও রেলে সিন্ডিকেট ধরে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি।
২০১১ সালে ম্যাক্স ২০৯ কোটি টাকার চিনকি আস্তানা রেল প্রকল্প পায়। এরপর ২০১৫ সালে ৬ হাজার কোটি টাকার আখাউড়া-লাকসাম রেল প্রকল্প, ২০১৬ সালে ১৮ হাজার কোটি টাকার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পও পায়। অথচ প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ১৬ কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন করার অভিজ্ঞতা রাখত।
রেল খাতে অভিজ্ঞতা ছাড়াই বিশাল প্রকল্প হাতিয়ে নেওয়ার পেছনে ম্যাক্সের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরের রাজনৈতিক সংযোগ ও শক্তিশালী লবির ভূমিকা ছিল।
ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মালিক আলমগীর নিজেকে আওয়ামী লীগের বড় দাতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে তিনি দুর্নীতির দায়ে কারাভোগ করেন, বর্তমানে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা চলমান।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে রেলের একাধিক প্রকল্প পেয়েছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ১০ নম্বরে থাকলেও প্রতিযোগিতাহীনভাবে ৯০ শতাংশ প্রকল্পের কাজ তারা পায়। অভিযোগ রয়েছে, ৩০ শতাংশ কমিশনের বিনিময়ে এই কাজগুলো তাদের হাতে দেওয়া হতো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক দরপত্রে জয়েন্ট ভেঞ্চার করার শর্ত থাকলেও ম্যাক্স প্রকল্পগুলোতে অংশ নেওয়ার যোগ্যতাই রাখত না। দরপত্র দলিলে জালিয়াতি করে তারা বড় বড় কাজ হাতিয়ে নেয়।
উদাহরণ হিসেবে, কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের দরপত্র বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী ২৭০ মিলিয়ন ডলারের (২২৬৮ কোটি টাকা) কাজের অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। অথচ ম্যাক্সের অভিজ্ঞতা ছিল মাত্র ১৬ কোটি টাকার প্রকল্পে। এরপরও রাজনৈতিক সুপারিশ ও মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তারা প্রকল্পগুলো পেয়ে যায়।
সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস করে ম্যাক্স ও তমা কনস্ট্রাকশন দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণের কাজ করে। ফলে পাহাড়, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিশেষজ্ঞরা এই অনিয়ম বুঝতে পেরে প্রতিবাদ করেন, এমনকি প্রকল্প মূল্যায়ন প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করতেও অস্বীকৃতি জানান বুয়েটের অধ্যাপক হাসিব মোহাম্মদ আহসান।
বাংলাদেশ রেলের ইতিহাসে এত বড় দুর্নীতি নজিরবিহীন। রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরও এই সিন্ডিকেট কীভাবে সক্রিয় থাকল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রেল মন্ত্রণালয়ের বিশাল দুর্নীতির নেপথ্যের ব্যক্তিদের বিচার না হলে, ভবিষ্যতে উন্নয়ন খাতের নামে আরও দুর্নীতি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
Leave a comment