রাজনীতিতে অভ্যুত্থানের উত্তরসূরি হয়ে আত্মপ্রকাশ করলেও মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি—এনসিপি। বিএনপি, জামায়াতসহ দেশের প্রায় সব বড় রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়ে দলটি এখন একা হয়ে পড়েছে রাজনৈতিক ময়দানে। আর সেই একাকীত্ব থেকে জন্ম নিচ্ছে অস্বস্তি, বিভ্রান্তি এবং নেতৃত্বে ভাঙনের ইঙ্গিত।
দলের ভেতরের চাপে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করতে চাইলে নতুন করে আলোচনায় আসে এনসিপি। যদিও পরে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তার সঙ্গে বৈঠকে বসে তাকে থেকে যাওয়ার অনুরোধ জানান এবং সংযত আচরণের প্রতিশ্রুতি দেন।
অভ্যুত্থানের অন্যতম শক্তি বিএনপি’র সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়ে এনসিপি। ইশরাক হোসেনের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে শপথ নিয়ে দুই পক্ষের তিক্ততা চূড়ায় পৌঁছে। এনসিপি সরকারের পক্ষাবলম্বন করে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে, যা বিএনপির পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া এনে দেয়। এই পরিস্থিতিতে এনসিপি নেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের মধ্যেই একে অপরকে দোষারোপ করে স্ট্যাটাস দিতে থাকেন।
বিশেষ করে উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের আগ্রাসী অবস্থান এবং বিভাজনমূলক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দলে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তবে গতকালের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর তিনি স্ট্যাটাস দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ঐক্যের বার্তা দেন। একইসঙ্গে দাবি করেন, সরকারের সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও তিনি এবং অন্য উপদেষ্টারা এখন থেকে সংযত থাকবেন এবং অভ্যুত্থানের সকল শক্তির প্রতি সম্মান দেখিয়ে কাজ করবেন।
দলের যুগ্ম সদস্য সচিব রিফাত রশিদ, দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখপাত্র হাসনাত আব্দুল্লাহ, সমর্থক আব্দুল্লাহ হিল বাকী এবং বিতর্কিত নেতা আব্দুল হান্নান মাসুদ—প্রায় সবাই স্ট্যাটাসে আত্মসমালোচনা করেছেন এবং দলীয় অবস্থানের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। তারা একে একে স্বীকার করছেন, এনসিপি দল গঠনের পর থেকেই মিত্র খোঁজার বদলে প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করেছে এবং অভ্যুত্থানের ঐক্যকে ছিন্ন করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান দলটির ভবিষ্যৎ পথচলাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। অভ্যুত্থানের আদর্শিক শক্তিকে একত্র করতে না পেরে, বরং বিরোধ বাড়িয়ে চলা একটি নবীন দলের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।
এনসিপি যদি দ্রুত ভেতরের দ্বন্দ্ব নিরসন ও বিভাজন কাটিয়ে একটি বাস্তববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির পথে না আসে, তবে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ক্রমশ অনিশ্চয়তার গহ্বরে হারিয়ে যাবে—এমনটাই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ এক যুগের গণআন্দোলনের ফসল ছিল জুলাই অভ্যুত্থান। সেই ঐতিহাসিক ঐক্য আজ নিজেদের হাতেই ভেঙে চুরমার হচ্ছে। শত্রু-মিত্র না চেনার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এনসিপিকে দ্রুততর পতনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে—এতে সন্দেহ নেই। এখন দেখার বিষয়, দলটির নেতৃত্ব সময়ের সংকেত বুঝে পুনরায় ঐক্য গড়ার পথে এগোয়, নাকি আত্মঘাতী অহমিকা নিয়ে আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
Leave a comment