ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর—মহাকাশের এমন এক রহস্যময় অস্তিত্ব, যার মাধ্যাকর্ষণ এতটাই শক্তিশালী যে আলোও বের হতে পারে না। নক্ষত্র ধসে পড়ে যখন নিজের ওজনেই সংকুচিত হয়, তখন এই কৃষ্ণগহ্বরের জন্ম হয়। একটি কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্রীয় ঘন বিন্দুকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি, যা দিগন্তসীমা বা ইভেন্ট হরাইজন দ্বারা বেষ্টিত থাকে। এটি সরাসরি দৃশ্যমান না হলেও আশপাশের বস্তু ও বিকিরণের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করে এদের উপস্থিতি শনাক্ত করা যায়।
সম্প্রতি আবিষ্কৃত গাইয়া বিএইচ১ হলো পৃথিবীর নিকটতম ব্ল্যাকহোল। ওফিউকাস নামক নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত এই ব্ল্যাকহোলটি পৃথিবী থেকে মাত্র ১,৫০০ আলোকবর্ষ দূরে। এটি একটি বাইনারি সিস্টেমের অংশ, যার অন্য একটি অংশ সূর্যের মতো একটি নক্ষত্র। গাইয়া বিএইচ১ তেমন সক্রিয় নয়, ফলে এটি শনাক্ত করাও ছিল দুঃসাধ্য। ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার গাইয়া উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে এই ব্ল্যাকহোল আবিষ্কার সম্ভব হয়, কারণ এর মহাকর্ষীয় টান সঙ্গী নক্ষত্রের গতিতে পার্থক্য তৈরি করেছিল।
অন্যদিকে, টিওএন৬১৮ হলো মহাবিশ্বে এখন পর্যন্ত জানা সবচেয়ে বড় ব্ল্যাকহোল। এটি সূর্যের চেয়ে ৬ হাজার ৬০০ কোটি গুণ বেশি ভারী। কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই ব্ল্যাকহোলটি একটি কোয়াসারের মধ্যে রয়েছে এবং তীব্র আলো নির্গত করে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও রয়েছে একটি অতিবৃহৎ ব্ল্যাকহোল—স্যাজিটেরিয়াস আ স্টার। এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ২৬ হাজার আলোকবর্ষ দূরে এবং এর ভর সূর্যের প্রায় ৪০ লাখ গুণ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে লাখ লাখ ব্ল্যাকহোল থাকতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত সরাসরি মাত্র কয়েক ডজন শনাক্ত হয়েছে। এদের বেশিরভাগই ছোট, নীরব ও নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু ব্ল্যাকহোল বাইনারি সিস্টেমে প্রবেশ করে আশপাশের পদার্থ টেনে নিচ্ছে, যা তাদের শনাক্ত করতে সহায়তা করছে।
ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে একটি আকর্ষণীয় তথ্য হলো—যেখানে সাধারণ ধারণা মতে তারা অগ্নিগর্ভ ও অতি উত্তপ্ত, বাস্তবে ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রস্থলের তাপমাত্রা হতে পারে পরম শূন্য, অর্থাৎ -২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই চরম শীতলতা সৃষ্টির পেছনে কারণ হলো, সিঙ্গুলারিটি এক অসম্ভব ঘন ও মাধ্যাকর্ষণপূর্ণ বিন্দু, যেখানে পদার্থবিদ্যার প্রচলিত নিয়ম কার্যকর থাকে না। তবুও দিগন্তসীমার বাইরের অঞ্চল থেকে হকিং বিকিরণের মাধ্যমে ক্ষীণ আভা বের হতে পারে, যা কোয়ান্টাম প্রভাবের ফল।
ব্ল্যাকহোল তৈরি হয় সাধারণত বিশাল নক্ষত্রের জীবনচক্র শেষে, যখন নিউক্লিয়ার ফিউশনের জ্বালানি ফুরিয়ে যায়। তখন তারাটি মাধ্যাকর্ষণের টানে ভেঙে পড়ে এবং তার কেন্দ্র সংকুচিত হয়ে সিঙ্গুলারিটি তৈরি করে। তার বাইরের স্তর একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে। সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল গঠনের ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ছোট ব্ল্যাকহোলের সংযুক্তি বা গ্যাস মেঘের পতন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ব্ল্যাকহোলের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো অ্যাক্রিশন ডিস্ক—একটি ঘূর্ণায়মান বলয় যা গ্যাস, ধুলা ও অন্যান্য বস্তু নিয়ে গঠিত। এসব বস্তু ব্ল্যাকহোলের দিকে টানতে টানতে উজ্জ্বল বিকিরণ সৃষ্টি করে, যা অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। ব্ল্যাকহোল আশেপাশের আলোকে এমনভাবে বিকৃত করে যে সেটি রিং আকৃতির হয়ে ওঠে, যাকে বলা হয় মহাকর্ষীয় লেন্সিং। এই প্রযুক্তির মাধ্যমেই ২০১৯ সালে প্রথম একটি ব্ল্যাকহোলের ছায়ার ছবি ধারণ করে ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ।
ব্ল্যাকহোল—এ যেন মহাবিশ্বের এক গভীর নিঃশব্দ গ্রাস। যদিও বিজ্ঞানীরা এদের সম্পর্কে আরও জানার চেষ্টা করছেন, এখনও এর অনেক দিক রয়েছে রহস্যাবৃত। তবে প্রযুক্তির অগ্রগতি ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার উন্নয়নের ফলে অচিরেই হয়তো এ রহস্যের আরও অনেক উন্মোচন হবে।
Leave a comment