Home জাতীয় রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
জাতীয়

রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস

Share
Share

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের গৌরবময় অধ্যায় হলো ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২। এ দিন ঢাকার রাজপথে বীর সন্তানরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তাদের সেই আত্মত্যাগ শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গের এই ঘটনাই পরবর্তীকালে জাতিসংঘের স্বীকৃতিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয় দুটি অংশে—পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) । সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বললেও পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন—উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণা বাঙালিদের জন্য ছিল অন্যায় ও অপমানজনক। এর প্রতিবাদে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়, যা ধীরে ধীরে ব্যাপক গণআন্দোলনে পরিণত হয়।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ। সেদিন সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে যেকোনো ধরনের জমায়েত নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু ছাত্ররা একে অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা থেকে মিছিল বের করে। সকাল ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করেন। মিছিলটি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের দিকে এগোলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। দুপুরের দিকে ছাত্ররা আবার মিছিল বের করলে পুলিশ গুলি চালায়। কিন্তু, ছাত্ররা তাতে থেমে না গিয়ে স্লোগান দিতে থাকে—আমার ভাষার অধিকার চাই! সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিকসহ অনেক ছাত্র শহীদ হন।
এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে পুরো পূর্ববাংলা উত্তাল হয়ে ওঠে। শহীদদের আত্মত্যাগের ফলে ভাষা আন্দোলন নতুন গতি পায় এবং ধীরে ধীরে পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ভাষা আন্দোলনই ছিল পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধিকার চেতনা জাগ্রত হয়, যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দেয়।
১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করে, যা ২০০০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে।
২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির জন্য শুধু একটি তারিখ নয়, এটি তাদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক। ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আজকের দিনে আমাদের শপথ হতে হবে—নিজের মাতৃভাষাকে মর্যাদা দেওয়া, শুদ্ধভাবে চর্চা করা এবং বিশ্বদরবারে বাংলা ভাষার গৌরব উজ্জ্বল করা। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের শিখিয়েছে—ভাষা শুধু একটি যোগাযোগের মাধ্যম নয়, এটি একটি জাতির আত্মবিশ্বাসের চিহ্ন। একুশ মানে মাথা নত না করা, একুশ মানে আত্মপরিচয়ের জয়গান!

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don't Miss

বরিশালে শিশু ধর্ষণের আসামি গণপিটুনিতে নিহত

বরিশালে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত এক যুবক গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। শনিবার (১৫ মার্চ) সন্ধ্যায় বরিশাল নগরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের জিয়ানগরে স্থানীয় জনতা তাকে...

রাখাইনে মানবিক সহায়তায় করিডোর চায় জাতিসংঘ, বাংলাদেশের সহযোগিতা প্রয়োজন

মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সংঘাতের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা পাঠাতে বাংলাদেশকে করিডোর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। শনিবার (১৫ মার্চ) ঢাকায় এক যৌথ সংবাদ ব্রিফিংয়ে...

Related Articles

ঈদ উপহার বিতরণ অনুষ্ঠানে ইলিয়াসপত্নী লুনা

সিলেট, ১১ মার্চ: সিলেটের দৌলতপুর ইউনিয়নের হাসনাজি গ্রামের প্রবাসী বিএনপির নেতৃবৃন্দের উদ্যোগ...

ব্রাজিলে তিন শিংওয়ালা গরু, বিস্মিত সবাই

বিশ্বে আশ্চর্যের কোনো কমতি নেই। কখনো শোনা যায় দুই মাথার মানুষ, কখনো...

শান্তিনগরে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার ৪ জন, দুই দিনের রিমান্ড

রাজধানীর শান্তিনগর বাজারে চাঁদাবাজির সময় হাতেনাতে ধরা পড়া চার যুবককে দুই দিনের...

বেবিচকের আলাদা নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের খবর ‘অপপ্রচার’

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) আলাদা নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের যে খবর...