পৃথিবীর নানা প্রান্তে যখন ঈদুল আজহার আনন্দে ভাসছে কোটি কোটি মুসলমান, তখন ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার মানুষ ঈদের প্রভাতে জেগে উঠছেন ধ্বংসস্তূপের নিচে, ক্ষুধার তাড়নায় ক্লান্ত শরীর নিয়ে, এবং হারানোর অসহনীয় বেদনা বুকে চেপে। দ্বিতীয় বছরের মতো, ঈদের সেই পরিচিত হাসি, আনন্দ আর উৎসবের রঙ হারিয়ে গেছে গাজার প্রতিটি অলিগলিতে।
দখলদার ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদী বর্বর সামরিক অভিযানে গাজায় মানবিক বিপর্যয় এখন চরমে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৫৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ, অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেছেন। চিকিৎসা সংকট, ওষুধের ঘাটতি আর হাসপাতালের ওপর লাগাতার হামলায় স্বাস্থ্যসেবা প্রায় ভেঙে পড়েছে।
ঈদের মাত্র একদিন আগে, বৃহস্পতিবার (৫ জুন) আবারও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার হাজার আল-আহলি হাসপাতালে। এই হামলায় অন্তত তিনজন সাংবাদিকসহ বহু হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। একদিকে ধ্বংসযজ্ঞ, অন্যদিকে খাদ্যাভাব—সব মিলিয়ে এক অমানবিক পরিস্থিতিতে পবিত্র কোরবানির ঈদ迎 করছে গাজাবাসী।
সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ আরব জানিয়েছে, গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত। প্রায় ১৯ লাখের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুল, হাসপাতাল কিংবা উন্মুক্ত স্থানে। ঈদে যেখানে খাবার, কোরবানি আর পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে সময় কাটানোর কথা ছিল, সেখানে এখন এক খণ্ড রুটি জোগাড় করাই বড় চ্যালেঞ্জ।
খান ইউনিসের এক অস্থায়ী তাবুতে আশ্রিত হুসাম আবু আমের বলেন, “ঈদে আমার সন্তানদের নতুন জামা আর খেলনা উপহার দিতাম। ঈদ ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময়। কিন্তু এবার ঈদে তাদের একমাত্র চাওয়া হলো—এক খণ্ড রুটি।” দখলদারদের হামলায় ধ্বংস হয়েছে তার ঘরবাড়ি, প্রাণ হারিয়েছেন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা। স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বাড়ি আর প্রিয়জনদের হারিয়ে তিনি আজ পরিবারসহ উদ্বাস্তু।
হুসাম জানান, গত ঈদে তিনি সন্তানদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে, আগামী ঈদের আগে যুদ্ধ শেষ হবে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে গাজা। কিন্তু সেই আশ্বাস আজ রয়ে গেছে কেবলই এক করুণ মিথ্যে হিসেবে। এবার তিনি তাদের আর কিছু বলতেও পারছেন না।
যখন মুসলিম বিশ্ব ঈদের খুশিতে মুখর, তখন গাজার আকাশে বাজছে বোমার শব্দ, আর ঈদের নতুন জামার বদলে শরণার্থী শিশুরা জড়াচ্ছে ছেঁড়া চাদর। ঈদুল আজহা, যার মূল বার্তা কোরবানি ও সহমর্মিতা—সেই শিক্ষা আজ যেন সবচেয়ে বেশি দরকার গাজাবাসীর জীবনে, অথচ তা-ই সবচেয়ে বেশি অনুপস্থিত।
Leave a comment