যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরের উপকণ্ঠে শনিবার ভোরে ঘটে গেল এক রক্তাক্ত রাজনৈতিক হামলা, যেখানে গুলিতে নিহত হয়েছেন প্রভাবশালী নারী আইনপ্রণেতা মেলিসা হর্টম্যান ও তাঁর স্বামী মার্ক। একই হামলাকারীর গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছেন আরেক সিনেটর জন হফম্যান ও তাঁর স্ত্রী ইভেট, যাঁরা এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
স্থানীয় সময় ভোররাতের স্তব্ধতা ভেঙে আচমকা এই সন্ত্রাসী হামলা যখন ঘটে, তখন সেখানকার দুটি রাজনৈতিক পরিবার ঘুমে ছিলেন। গভর্নর টিম ওয়ালজ একে সরাসরি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সহিংসতা’ বলে আখ্যায়িত করেন এবং হামলাকারী পুলিশের পোশাকে ছিল বলেও নিশ্চিত করেন। ঘটনাটি ঘটে দুটি পৃথক বাড়িতে, কিন্তু হামলার ধরণ ও সময়ের ব্যবধান ছিল খুবই কাছাকাছি—মাত্র ৯০ মিনিট।
নিহত মেলিসা হর্টম্যান ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলের রাজনীতিক এবং মিনেসোটার সাবেক স্পিকার। তিনি রাজ্য রাজনীতিতে প্রগতিশীল ভাবধারার এক শক্তিশালী মুখ। তাঁর সঙ্গে নিহত স্বামী মার্ক, যিনি দীর্ঘদিন মেলিসার রাজনৈতিক সহচর ছিলেন, ঘরে ঢুকে তাদের গুলি করে হত্যা করে এক অজ্ঞাত বন্দুকধারী।
এর আগে একই কায়দায় গুলি করা হয় সিনেটর জন হফম্যান ও তাঁর স্ত্রী ইভেটকে। তাঁরা হাসপাতালে গুরুতর অবস্থায় চিকিৎসাধীন, অস্ত্রোপচার হয়েছে, এবং চিকিৎসকরা আশাবাদী হলেও শঙ্কা কাটেনি পুরোপুরি।
গভর্নর ওয়ালজ মিনেসোটার মানুষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “এটা রাজনৈতিক মতপার্থক্য নয়, বরং গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর হামলা। আমাদের শান্তিপূর্ণ আলোচনার ঐতিহ্যকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা তা হতে দেব না।”
পুলিশ জানায়, হামলাকারী প্রথমে হফম্যান দম্পতির বাড়িতে ঢুকে তাঁদের ওপর গুলি চালায়। এরপর দ্বিতীয়বার হামলা চালায় হর্টম্যান দম্পতির বাড়িতে। দুই ঘটনার পেছনে একই অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে তদন্তকারী দল। পুলিশি ভাষ্যে বলা হয়েছে, হামলার পর হামলাকারীর সঙ্গে পুলিশের সংক্ষিপ্ত গুলিবিনিময় হয়, তবে সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
এ ঘটনায় গোটা রাজ্যে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশ, এফবিআই এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি যৌথভাবে একটি বিশাল অভিযান চালাচ্ছে বন্দুকধারীকে গ্রেপ্তারের জন্য। হামলাকারীর পরিচয় ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত চললেও এ মুহূর্তে কর্তৃপক্ষ তার পরিচয় প্রকাশ করেনি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বিবৃতিতে এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন, “এটি উদ্দেশ্যমূলক হামলা, আইনপ্রণেতাদের লক্ষ্য করেই হামলা চালানো হয়েছে। এই ধরনের বর্বরতা আমেরিকায় বরদাস্ত করা হবে না।” তিনি মিনেসোটার মানুষের জন্য প্রার্থনা করেন এবং বলেন, “তারা দুর্দান্ত, সাহসী, সহনশীল জনগণ।”
এই ঘটনা এমন এক সময় ঘটল, যখন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিভাজন চরমে। ট্রাম্প-বিরোধী বিভিন্ন নীতিকে কেন্দ্র করে শনিবার সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে আসেন। সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনাটি তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে, অনেকেই একে ‘গৃহযুদ্ধের পূর্বাভাস’ বলেও মন্তব্য করছেন।
এ ঘটনার পর মিনেসোটা স্টেট ক্যাপিটল ভবনে বাড়তি নিরাপত্তা জারি করা হয়েছে। আইনপ্রণেতাদের চলাচলের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে পুরো এলাকা। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হামলা ঠেকাতে কেন্দ্রীয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অধিক সক্রিয় ভূমিকা নিতে বলা হয়েছে।
ঘটনার তদন্ত এখন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। সম্ভাব্য রাজনৈতিক চক্রান্ত, হামলাকারীর অতীত কর্মকাণ্ড ও সশস্ত্র প্রশিক্ষণ–সবই তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে।
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ মতবিনিময়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বেশ কিছু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্ত থাকলেও গত এক দশকে একসঙ্গে এতজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে লক্ষ্য করে হামলার ঘটনা বিরল। মিনেসোটার এই রক্তাক্ত সকাল সেই ইতিহাসে যোগ করল এক নতুন কলঙ্কজনক অধ্যায়।
Leave a comment