ভূমধ্যসাগরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে পাঁচ বাংলাদেশী দেশে ফিরে এসেছেন, যারা ইউরোপে উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন কিন্তু পড়ে যান মানবপাচার চক্রের ফাঁদে। প্রতারকদের মাধ্যমে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর তারা ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। রাজধানী ত্রিপোলিতে পাচারকারীরা তাদের আটক করে ভয়াবহ নির্যাতন চালায় এবং পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য চাপ দেয়। শেষ পর্যন্ত মুক্তিপণ পরিশোধের পর পাচারকারীরা তাদের ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে পাঠানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ভাগ্য তাদের জন্য ছিল আরও কঠিন।
সাগরে যাত্রার সময়ই তাদের নৌকা বিকল হয়ে পড়ে। বিপদে থাকা অবস্থায় তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড তাদের উদ্ধার করে। এরপর শুরু হয় আরেক দুঃসহ অধ্যায়—তাদের আলজেরিয়া সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করতে হয়। দীর্ঘ সংগ্রামের পর বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড এবং আলজেরিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রচেষ্টায় তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
অবশেষে শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ভোর সাড়ে ৫টায় টার্কিশ এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে আলজেরিয়া থেকে দেশে পৌঁছান এই পাঁচ বাংলাদেশী—ঢাকার মোস্তাকিম সরকার, শেরপুরের মোজাম্মেল হক, মাদারীপুরের জিহাদ ফকির, রোমান হাওলাদার ও ইয়াসিন হাওলাদার। এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পর তাদের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
মাদারীপুরের ইয়াসিন হাওলাদার জানান, লিবিয়ায় তারা মাফিয়াদের হাতে বন্দি ছিলেন, যারা পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। তার পরিবার জমি বন্ধক রেখে, ঋণ নিয়ে এবং আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার করে পাচারকারীদের মোট ২৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। এখন তার পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে।
এপিবিএনের পরিদর্শক শাহ আলম মৃধা জানান, পাচারের শিকার এই ব্যক্তিদের দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে ব্র্যাকের উদ্যোগসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিনি আরও বলেন, ‘ইউরোপে যাওয়ার জন্য দেশত্যাগ করা বাংলাদেশীরা যে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন, তা হৃদয়বিদারক। ভবিষ্যতে যেন কেউ এমন প্রতারণার শিকার না হন, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।’
এই ঘটনা মানবপাচারের ভয়াবহ দিকটি আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত বহু মানুষ এমন বিপদের মুখে পড়ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে কাজ বা বসবাসের পরিকল্পনা করার আগে নিশ্চিত হওয়া জরুরি যে তা বৈধ এবং নিরাপদ উপায়ে হচ্ছে কিনা, নইলে এর পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক।
Leave a comment