২৮ মে, ১৯৫০
বাঙালির পরিচয়, আত্মমর্যাদা ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের মূল ভিত্তি তার ভাষা। কিন্তু সেই ভাষাকে নিঃশেষ করার ষড়যন্ত্র আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সরকার একদিকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, অন্যদিকে সেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে বাংলার বিরুদ্ধে নতুন চক্রান্তের জাল বুনছে।
সম্প্রতি সরকার একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে—উর্দু হরফে বাংলা ভাষার বই রচনার জন্য লেখকদের কাছে ‘টেন্ডার’ আহ্বান করা হয়েছে। অথচ ভাষা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত ‘ভাষা কমিটি’ এখনো কোনো সুপারিশ দেয়নি। কিন্তু সরকারের অতি-উৎসাহী কতিপয় অংশ রাতারাতি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এর চেয়েও ভয়ংকর বিষয় হলো, সরকারি অর্থে নামবিহীন বই প্রকাশ করে বাংলার জন্য উর্দু হরফের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হচ্ছে। এসব বইয়ের মধ্যে অন্যতম দুটি হলো—”দূরদর্শী লিখিত হরফ সমস্যা” এবং “Farsight লিখিত The Script Question”। এইসব ছদ্মনামে প্রকৃতপক্ষে কারা লিখছেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাদের উদ্দেশ্য একটাই—উর্দু হরফকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করা।
শুধু তাই নয়, সরকারি আদেশে পূর্ববঙ্গের দাপ্তরিক কাজকর্ম উর্দুতে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকারি দপ্তরগুলোতে অভ্যন্তরীণ চিঠিপত্র এখন থেকে উর্দুতে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। এভাবে একটি জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ভাষার শেকড় উপড়ে ফেলার চেষ্টা চলছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—বাঙালি কি এভাবে নীরবে সব মেনে নেবে? সরকার কি সত্যিই ভাবছে, জনগণ কিছু বলবে না? ছাত্রসমাজ, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। কিন্তু আন্দোলন দমন করার জন্য প্রশাসন নানারকম কৌশল অবলম্বন করছে।
ঢাকার এক খ্যাতিমান অধ্যাপক, যিনি প্রকাশ্যে বাংলা হরফের পক্ষে কথা বলেছিলেন, তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের এক অধ্যাপক, যিনি স্বাধীন মতামত প্রকাশ করেছিলেন, তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে—”উর্দু হরফে বাংলা লেখা রাষ্ট্রীয় নীতি (State Policy)”।
এই ‘রাষ্ট্রীয় নীতি’ আসলে কার? জনগণের? নাকি ক্ষমতার গুটিকয়েক ব্যক্তির?
এই বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রয়োজন। যদি সরকার এ বিষয়ে চুপ থাকে, তাহলে জনগণ ধরে নেবে—এটি নিছক গুজব নয়, বরং পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। লাখ লাখ মোহাজের মানবেতর জীবনযাপন করছে। খাদ্য নেই, আশ্রয় নেই, কাজ নেই। অথচ এই দুঃসময়ে সরকার শিক্ষা ও উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমিয়ে উর্দু হরফ প্রচারের জন্য বাজেট বরাদ্দ করছে। ট্রেনিং সেন্টার খোলার পরিকল্পনা চলছে, উর্দু হরফে লেখা বই বিতরণের তোড়জোড় চলছে।
এই প্রশ্ন থেকেই যায়—জনগণের করের টাকা এভাবে অপচয়ের অধিকার সরকার পেল কোথায়?
ছাত্রসমাজ ও জনগণের পক্ষ থেকে আমরা সরকারকে স্পষ্ট বার্তা দিতে চাই—
যদি এই ষড়যন্ত্র বন্ধ না করা হয়, তাহলে কলেজ-ভার্সিটি বন্ধ হবে। আন্দোলন এবার আর বিচ্ছিন্ন থাকবে না। ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে রাজপথে নামবে। বাংলার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আমরা লড়তে প্রস্তুত!
চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক জনসভা, ২৫ মার্চ, ১৯৫১
১২ মার্চ চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে এক অভূতপূর্ব জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পাক তমদ্দুন মজলিসের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই সমাবেশে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, ব্যবসায়ী—সব শ্রেণির মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা জনাব আবুল খায়ের সিদ্দিকী। প্রধান বক্তা ছিলেন কবি আবদুস সালাম। এছাড়া বক্তব্য রাখেন সাংবাদিক অম্বিক দাস, ছাত্রনেতা এজহারুল হক ও শ্রমিক নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী।
সমাবেশের মূল দাবিগুলো ছিল—বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। বক্তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেন—বাংলার জনগণ তাদের মাতৃভাষার জন্য শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়বে!
এ জনসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হবে। ছাত্রনেতারা দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দেন—”আমাদের দাবি না মানা হলে, প্রতিটি বাঙালির ঘরই আন্দোলনের দুর্গে পরিণত হবে!”
২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে সকাল থেকেই ছাত্রদের ভিড় বাড়তে থাকে। তাদের একটাই দাবি—বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
কিন্তু সরকার সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। বেলা ১১টার দিকে পুলিশ মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে গ্যাস নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে লাঠিচার্জ শুরু হয়, এবং হঠাৎ করেই গুলির শব্দে আকাশ ফেটে যায়! রমনা এলাকা রক্তাক্ত হয়ে ওঠে।
সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকেই পুলিশের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে আহতদের চিকিৎসার জন্য রক্তের সংকট দেখা দেয়। চারদিকে তখন একটাই আওয়াজ—”আপনার রক্ত দিন! আহত বন্ধুরা রক্তের অভাবে মারা যাচ্ছে!”
জনসাধারণ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। মেডিকেল কলেজ হোস্টেল থেকে ছাত্রদের মাইকিং চলতে থাকে— “রক্তের বদলে রক্ত চাই!”
এই হত্যাযজ্ঞের খবর ছড়িয়ে পড়তেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা সব জায়গায় প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান বিধানসভা ভবনের দিকে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা এগোতে থাকলে, পুলিশ আরও কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ে।
তমদ্দুন মজলিস এক বিবৃতিতে পুলিশের বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলে—”এই হত্যাযজ্ঞের নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই!”
১৩ মে, ১৯৫১
লাহোরের রাস্তায় কয়েকজন বাঙালি ছাত্র নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলছিলেন। তখন এক স্থানীয় ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করলেন—”এ কোন ভাষা? এটা কি হিন্দি?”
এটাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের বাংলা ভাষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি। অথচ বাংলা ছিল পাকিস্তানের ৫৬% মানুষের ভাষা! ১৯৫০ সাল পর্যন্ত পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্ত ছিল, কিন্তু ১৯৫১ সালে সেটিও বাতিল করা হয়।
বাংলার বিরুদ্ধে এই বৈষম্য যতদিন চলবে, ততদিন বাংলার জনগণও নিজেদের অধিকার আদায়ের লড়াই চালিয়ে যাবে। বাংলার প্রতি অবজ্ঞার পরিণতি কী হতে পারে, তা সরকারই ঠিক করুক!
Leave a comment