বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী ভারত কার্যত আইনগতভাবেই ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য— এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস)-এর সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামান। শনিবার (২২ নভেম্বর) ঢাকায় আয়োজন করা ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন’-এর একটি অধিবেশনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার সময় তিনি এই মন্তব্য করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। সেই চুক্তির আওতায় ভারত আইনগতভাবেই তাকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য।” মুনিরুজ্জামান বলেন, প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশ হিসেবে ভারতের উচিত বাংলাদেশের বিচারিক প্রক্রিয়াকে সম্মান জানানো। তিনি মন্তব্য করেন, “যদি ভারত আন্তর্জাতিক নিয়ম, নীতি-নৈতিকতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে, তবে তাদের সমভাবে বাংলাদেশের বিচারিক কাঠামোকেও সম্মান জানানো উচিত।”
তিনি আরও দাবি করেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হয়েছে এবং এই রায়কে সম্মান করা প্রতিবেশী দেশগুলোর নৈতিক দায়িত্ব। তার ভাষায়, “যদি সেই সম্মান বজায় থাকে, তবে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোই যুক্তিযুক্ত।” এক পর্যায়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন তুলেন—“যদি বাংলাদেশ কোনো দণ্ডিত ভারতীয় নাগরিককে আশ্রয় দিত এবং দিল্লির আনুষ্ঠানিক অনুরোধ সত্ত্বেও ফেরত না পাঠাত, তবে ভারত কী প্রতিক্রিয়া দেখাত?”
তিনি জানান, আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে যেকোনো দণ্ডিত ব্যক্তিকে ফেরত পাঠাতে রাষ্ট্রগুলো আইনগতভাবে বাধ্য। এ কারণে নয়াদিল্লির উচিত হবে দ্রুততম সময়ে শেখ হাসিনাকে ঢাকায় ফেরত পাঠানো। ‘ফ্র্যাকচার্ড অর্ডার্স, ফ্লুইড লয়্যালটিজ: পাওয়ার পলিটিক্স ইন দ্য পোস্ট-অ্যালাইনমেন্ট এজ’ শীর্ষক অধিবেশনটি পরিচালনা করেন জার্মানির আরটিএল নর্ড-এর সাংবাদিক ডেভিড প্যাট্রিশিয়ান।
আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন— মালয়েশিয়ার টেইলরস বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলিয়া রোকনিফার্ড, আগোরা স্ট্র্যাটেজি ইনস্টিটিউটের জোভান রাটকোভিচ, ব্রাজিলের এফজিভি ফাউন্ডেশনের লিওনার্দো পাজ নেভেস ,যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মারিয়ান ভিডাউরি। তারা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি, কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করেন।
গত ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত বছরের জুলাই–আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত নৃশংসতার দায়ে তাদের দুজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। রায় ঘোষণার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়,“মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী ব্যক্তিদের অন্য দেশে আশ্রয় দেওয়া অমিত্রসুলভ আচরণ এবং ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে এই প্রত্যর্পণ ইস্যু দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। চুক্তি থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনা, মানবাধিকার উদ্বেগ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা বাস্তবতা এই প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।
মুনিরুজ্জামানের বক্তব্য নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে—ভারত কি চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাবে, নাকি আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে ভিন্ন পথে হাঁটবে? বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা—দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে আশ্রয় দেওয়া ন্যায়বিচারের পরিপন্থী, আর ভারতের উচিত চুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান দেখানো।
Leave a comment