ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ‘বাবরি মসজিদ’ নির্মাণের ঘোষণাকে ঘিরে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা এলাকায় আগামী ৬ ডিসেম্বর ‘বাবরি মসজিদের’ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পরিকল্পনার কথা জানান তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক হুমায়ুন কবির।
তাঁর এই ঘোষণা মুহূর্তেই রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়, বিশেষ করে বিজেপির তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণে বিষয়টি দ্রুত জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, ঘোষিত ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন দিবস—৬ ডিসেম্বর—ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল তারিখ। ১৯৯২ সালের এই দিনেই অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়। সেই ঘটনার ৩৩তম বার্ষিকীতে নতুন একটি ‘বাবরি মসজিদ’ নির্মাণের ঘোষণা অনেকের কাছে রাজনৈতিকভাবে প্ররোচনামূলক বলে মনে হয়েছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা ছড়ানো একপ্রকার অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়।
ঘোষণার পরপরই বিরোধী দল বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসের ওপর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উসকে দেওয়ার অভিযোগ তোলে। দলটির মুখপাত্র ইয়াসের জিলানি দাবি করেন, ভোটের আগে রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের উদ্দেশ্যে তৃণমূল ইচ্ছাকৃতভাবে সংবেদনশীল ইস্যুকে সামনে আনছে।
জিলানি সাংবাদিকদের বলেন,“হুমায়ুন কবির ও তৃণমূলের আরও কয়েকজন নেতা ঘৃণার রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজ্যে ভোট সমাগত, আর তৃণমূল বুঝতে পারছে বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন আসছে। তাই বিভ্রান্তি ছড়ানোর পথ বেছে নিয়েছে তারা।”
বিজেপির অভিযোগ, ৬ ডিসেম্বরের মতো সংবেদনশীল দিনে ‘বাবরি মসজিদ’ নাম ব্যবহার করে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের ঘোষণা শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক অস্থিরতা তৈরিরও প্রচেষ্টা।
অন্যদিকে তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবির দাবি করেছেন, এই উদ্যোগকে রাজনৈতিক রঙ দেওয়ার সুযোগ নেই। তাঁর মতে, এটি স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের দাবি । তিনি জানান,“মসজিদ নির্মাণ সম্পূর্ণ আইনগত প্রক্রিয়া মেনে হবে। এটি নির্মাণে প্রায় তিন বছর সময় লাগবে। বিভিন্ন মুসলিম নেতা ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।”
কবির আরও বলেন, ‘বাবরি মসজিদ’ নামটি ঐতিহাসিক স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছে, এবং কোনোভাবেই অযোধ্যার মূল বাবরি মসজিদ ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংঘাত তৈরি করা তাঁদের উদ্দেশ্য নয়।শুধু রাজনৈতিক অঙ্গন নয়, ধর্মীয় নেতাদের মধ্যেও এ ঘোষণা নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
কংগ্রেস নেতা সন্দীপ দিক্ষিত মন্তব্য করেন,“মসজিদ বা যেকোনো উপাসনালয় নির্মাণ মানুষের মৌলিক অধিকার। কেউ মসজিদ বানালে তার সঙ্গে বাবরের সম্পর্ক টানা অর্থহীন। বিষয়টিকে অযথা বিতর্কিত করা উচিত নয়।”
কংগ্রেসের আরেক নেতা সুরেন্দ্র রাজপুত বলেন,“মন্দির, মসজিদ, চার্চ বা গুরুদ্বারা—এ সবই সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক। এগুলো ব্যক্তি কিংবা সম্প্রদায়ের অধিকার অনুযায়ী স্থাপিত হতে পারে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব তৈরি করা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা।”
অল ইন্ডিয়া ইমাম অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাওলানা সাজিদ রাশিদি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মন্তব্য করেন,“একবার যেখানে মসজিদ তৈরি হয়, সেটি কিয়ামত পর্যন্ত মসজিদ হিসেবেই থাকে। দেশে বাবরি মসজিদের নামে শত শত মসজিদ থাকলেও অযোধ্যার আসল বাবরি মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কখনোই কমবে না।”
এই বিতর্ককে ঘিরে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ধর্মীয় ও সংবেদনশীল ইস্যু নতুন করে গুরুত্ব পাচ্ছে। রাজ্যে তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে প্রতিযোগিতা যত বাড়ছে, ততই এ ধরনের ঘটনাগুলো রাজনৈতিক মেরুকরণকে আরও তীব্র করছে।
মুর্শিদাবাদে মুসলিম ভোটব্যাংক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেখানে একটি বহুল পরিচিত নাম ব্যবহার করে মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে তৃণমূল ভোটের আগে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে—এমন মন্তব্যও পাওয়া যাচ্ছে নানা মহল থেকে।
অন্যদিকে বিজেপি এই ঘোষণাকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূলকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিযোগে আরও চাপে ফেলতে চাইছে। তাদের লক্ষ্য, এই ইস্যুকে ঘিরে মুসলিম ও অমুসলিম উভয় ভোটারদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করা এবং তৃণমূলের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হলো—এই সংবেদনশীল বিষয়টি যাতে কোনোভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দিকে না যায়, তা নিশ্চিত করা। ‘বাবরি মসজিদ’ নির্মাণের এই ঘোষণা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে কতটা প্রভাব ফেলবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে স্পষ্ট যে, ঘোষণাটি ইতোমধ্যেই রাজ্যের রাজনৈতিক আবহকে উত্তপ্ত করে তুলেছে ।
Leave a comment