বাংলাদেশ রেলওয়ের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানা পার্বতীপুরকে ঘিরে উঠেছে ভয়াবহ দুর্নীতি, অর্থ লোপাট ও নারী কেলেঙ্কারির বিস্তৃত অভিযোগ। সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস হওয়া এক দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছেন রেলওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, যিনি বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী পদে আসীন। অভিযোগ রয়েছে, একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সহায়তায় তিনি এ পদে বসেছেন এবং পরবর্তীতে শুরু হয়েছে ‘লুটপাট উৎসব’।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাইফুল ইসলামকে পদে বসানোর প্রক্রিয়াটি ছিল কৌশলগত এবং রাজনৈতিক সুবিধাবাদের এক নোংরা দৃষ্টান্ত। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর, ফকির মো. মহিউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন একটি গোষ্ঠী তাকে উপপ্রধান থেকে প্রধান নির্বাহীর আসনে বসিয়ে দেয়। এরপর থেকে পার্বতীপুরের কারখানা কার্যত রূপ নেয় ‘এফএম বাহিনী’ নামে পরিচিত একটি সিন্ডিকেটের ব্যক্তিগত রাজ্যে।
অভিযোগ রয়েছে, সাইফুল ইসলামের নির্দেশনায় প্রত্যেক ঠিকাদারি কাজে ৫% ‘কমিশন’ নিতে হয়, যা এক প্রকার বাধ্যতামূলক ঘুষ। এমনকি কোনো ঠিকাদার যদি মাত্র ৯৫০ টাকা কম ঘুষ দেয়, তাহলে সেই ফাইল সই না করে আটকে রাখার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে। তার এই তুচ্ছ টাকার ঘুষ-আসক্তিকে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘লোভের পিশাচ’-এর নিদর্শন।
এছাড়াও, প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সাইফুল ইসলামের অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার বিস্ময়কর তথ্য। টাঙ্গাইলে তার নামে-বেনামে রয়েছে বিঘার পর বিঘা জমি, ঢাকায় ও চট্টগ্রামে একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি, যার সবই ঘুষ ও দুর্নীতির টাকায় গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ। নারী কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রেও তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তৃত অভিযোগ। অফিসে কর্মরত নারী কর্মচারীদের সাথে অশোভন আচরণ ও যৌন নিপীড়নের বিষয়টি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় সতর্কবার্তাসহ।
দুর্নীতির বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে তার আত্মীয়-স্বজন পরিচালিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। তারেকুল ইসলাম তারেকের মেগা বিল্ডার্স, টিকে এন্টারপ্রাইজসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দ হচ্ছে কোটি কোটি টাকার কাজ, যেখানে প্রতিযোগিতা বা ন্যায্যতা নেই বললেই চলে। অপরদিকে তালিম হায়াতের কোহিনূর এন্টারপ্রাইজ নামক প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত চলছে জিনিসপত্রের অতিরিক্ত দামে সরবরাহ। এক পণ্যের প্রকৃত আমদানি মূল্য ৮১৫ টাকা হলেও, সরকারি খাতায় দেখানো হয়েছে ৬০,৪৫৩ টাকা—যা ৭৩ গুণ বেশি।
চাঞ্চল্যকরভাবে জানা গেছে, তালিম হায়াত নিয়মিতভাবে রেল কারখানার অফিস কক্ষে বসে নিজের ঠিকাদারি অফিস পরিচালনা করছেন, যা সরকারি দপ্তরে সম্পূর্ণ বেআইনি এবং নিরাপত্তা লঙ্ঘনের শামিল।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এই দুর্নীতির সিন্ডিকেট শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এদের শিকড় ছড়িয়ে রয়েছে আমেরিকা ও কানাডাতেও। বিদেশে গড়ে উঠেছে অফিস ও গুদাম, যেখানে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে শত কোটি টাকা। প্রতিবেদনে একে “ডাকাতির বৈশ্বিক সাম্রাজ্য” বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এ প্রতিবেদন ইতিমধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সচেতন নাগরিকরা দাবি তুলেছেন, রেলওয়ের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সক্রিয় হতে হবে এবং তাদের সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
একসময় দেশের গৌরব হিসেবে বিবেচিত রেলওয়ে আজ পরিণত হয়েছে এক ভয়াবহ দুর্নীতির খনিতে, যেখানে প্রতিটি যন্ত্রাংশ যেন নীরবে আর্তনাদ করছে: “আমাকে বিক্রির টাকায় আর কত ফ্ল্যাট, কত জমি গড়া হবে?”
প্রশাসনের নীরবতা ও রাজনীতির ছায়া এই অপরাধ জগতকে আরও দুর্ভেদ্য করে তুলেছে। তদন্ত না হলে, বিচার না হলে, এই রাষ্ট্রীয় সম্পদের রক্তক্ষরণ থামবে না—এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকেরা।
Leave a comment