বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। দেশের প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে যিনি নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বিচার কার্য পরিচালনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাঁর কর্মজীবনের পরতে পরতে রয়েছে নারী ক্ষমতায়নের প্রেরণা, আইনের শাসনের প্রতি অগাধ নিষ্ঠা এবং অসীম সাহসিকতা।
১৯৫০ সালের ৮ জুলাই মৌলভীবাজারে জন্মগ্রহণ করেন নাজমুন আরা সুলতানা। তাঁর পিতা আবুল কাশেম মঈনুদ্দীন ও মাতা বেগম রশীদা সুলতানা দীন। মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবাকে হারানো এই মেয়েটি পরবর্তীতে মায়ের অনুপ্রেরণায় নিজেকে গড়েন সময়ের এক ব্যতিক্রমী নারী নেতৃত্বে। ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, মুমিনুন্নেসা উইমেন্স কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং আনন্দমোহন কলেজ থেকে স্নাতক শেষে তিনি ১৯৭২ সালে এলএলবি পাস করেন মোমেনশাহী ল কলেজ থেকে।
স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দশকে নারীর জন্য বিচার বিভাগে সুযোগ না থাকলেও, ১৯৭৪ সালে সেই বাধা অপসারিত হলে, পরের বছরই নাজমুন আরা সুলতানা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী বিচারক হিসেবে বিচার বিভাগে যোগ দেন। তাঁর কর্মস্থল ছিল খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও টাঙ্গাইল। পরবর্তীতে তিনি সাব-জজ হন ১৯৮২ সালে এবং দীর্ঘ ধারাবাহিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ১৯৯১ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে নিয়োগ পান।
২০০০ সালের ২৮ মে বাংলাদেশের হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে তার নিয়োগ হয় এবং দুই বছর পর তিনি স্থায়ীভাবে হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে যোগ দেন। এরপর ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রথম নারী বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। বিচার বিভাগে একজন নারী হিসেবে তাঁর এই সাফল্য ছিল অভূতপূর্ব, যা নারীর জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা তাঁর বিচারিক জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি দেওয়া ফতোয়া অবৈধ ঘোষণার রায়। এছাড়া খালেদা জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ি সংক্রান্ত মামলা, বাদপড়া ১০ বিচারপতির মামলা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী এবং ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়েও তিনি সক্রিয় ছিলেন।
তিনি কেবল বিচারক হিসেবে নয়, নারী নেতৃত্বের বিকাশেও রেখেছেন অসাধারণ অবদান। বাংলাদেশ উইমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের (BWJA) প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি কাজ করেছেন নারী বিচারকদের সংগঠিত ও দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে। আন্তর্জাতিক নারী বিচারক সংগঠনেও তিনি সাধারণ সম্পাদক ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মানিত করে।
পারিবারিক জীবনেও তিনি ছিলেন সুশৃঙ্খল ও দায়িত্বশীল। ১৯৭৫ সালে কাজী নুরুল হকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এই দম্পতির দুই পুত্র রয়েছে, যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
২০১৭ সালের ৬ জুলাই বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা অবসর গ্রহণ করেন। তবে তাঁর রেখে যাওয়া পথচিহ্ন আজো অনুসরণীয়, বিশেষত নারীর ক্ষমতায়ন ও বিচারিক স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে। তাঁর সাহসিকতা, মেধা ও অঙ্গীকার শুধু এক ব্যক্তির সাফল্য নয়, বরং একটি জাতির জন্য অনুপ্রেরণা ও গর্বের প্রতীক।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, যেমনটি তিনি নিজেই বলেছিলেন—”বিচার শুধু পেশা নয়, এটি একটি দায়িত্ব, আর আমি নারী হয়ে সেই দায়িত্বকে অহংকারে রূপ দিতে পেরেছি।”
Leave a comment