ফেনী ও নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ এলাকা কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিপাত এবং নদীর পানি বৃদ্ধির কারণে এখনও পানির নিচে। শহর, গ্রাম, সড়ক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার—সবকিছুই কার্যত থমকে আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসনের পূর্ব প্রস্তুতির অভাব, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা এবং অদক্ষ ব্যবস্থাপনার ফলে আজকের এই দুর্ভোগ—এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ও এলাকাবাসী। ৯ জুলাই রেকর্ড বৃষ্টিপাতের দিন থেকেই ফেনী শহর এবং আশপাশের এলাকার পরিস্থিতি মারাত্মকভাবে খারাপ হতে থাকে। মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় বাঁধ ভেঙে প্রবল গতিতে পানি ছড়িয়ে পড়ে ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া ও পরশুরাম উপজেলায়।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মে মাস থেকেই ফাটল দেখা দেওয়া বাঁধগুলো মেরামতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সংবাদকর্মীদের একাধিক প্রতিবেদনে এসব ফাটলের বিষয়ে সতর্ক করা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি। সরকার ২০২৪ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো মেরামতে প্রায় ২১ কোটি টাকা ব্যয় করেছিল, কিন্তু এবার জুলাই মাসের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতেই সেই বাঁধগুলোর বেশিরভাগ অংশ ভেঙে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, এখন ৭ হাজার ৩৪০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
এদিকে, ফেনী শহরের অব্যবস্থাপনার চিত্র আরও ভয়াবহ। শহীদুল্লা কায়সার সড়কসহ বহু এলাকা ডুবে গেছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। স্থানীয় এক বাসিন্দা মন্তব্য করেন, “জেলেই ভালো ছিলাম, অন্তত পানি উঠত না।” পৌরসভার অকার্যকরতা, প্রশাসক দিয়ে দায়িত্ব চালানো ও নাগরিক দুর্ভোগে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। পৌর প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বৃষ্টি বন্ধ হলে পানি নেমে যাবে—এ মন্তব্যকে এলাকাবাসী তাচ্ছিল্যের চোখে দেখছেন।
আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, ৮ জুলাই সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ফেনীতে ২২২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা মৌসুমি স্বাভাবিকতার মধ্যেই পড়ে। জলবায়ুবিদদের মতে, আষাঢ়-শ্রাবণের এই সময় দেশে এমন বৃষ্টিপাত নতুন নয়। তাই বর্ষাকাল এবং পূর্ণিমা-অমাবস্যার জোয়ার বিবেচনায় রেখে বাঁধ নির্মাণ ও জলনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকাই মূলত ভয়াবহ জলাবদ্ধতা ও বন্যার কারণ।
বন্যা পরিস্থিতির কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ, পরীক্ষা স্থগিত, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ এবং যাতায়াত বন্ধ হয়ে পড়েছে। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ফুলগাজীর ৬৭টি, পরশুরামের ২৭টি, ছাগলনাইয়ার ১৫টি, দাগনভূঞার ২টি এবং ফেনী সদরের ১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বহু এলাকায় বেড়িবাঁধের ওপর দিয়েই পানি প্রবেশ করেছে।
এই দুর্যোগ মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৯ হাজার মানুষ ফেনীর বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠছে, এই দুর্যোগ কি পূর্বাভাসহীন ছিল? পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং আবহাওয়া অধিদপ্তর আগেই জানিয়েছিল, জুলাইয়ে বৃষ্টিপাত এবং নদীর পানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তার পরও কেন দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি? কেন যথাসময়ে বাঁধ সংস্কার ও শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি?
নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীর পরিস্থিতিও ফেনীর মতোই করুণ। জলাবদ্ধতার কারণে শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন। কোম্পানীগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, সেনবাগ, সোনাইমুড়ীসহ একাধিক উপজেলায় বিপর্যয় নেমে এসেছে। জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি জানিয়েছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইউনিসেফ ও ডব্লিউএফপি প্রস্তুত আছে, তবে এখনো মাঠে নামেনি।
ফেনী ও নোয়াখালীর মানুষ এখন ত্রাণ নয়, চায় স্থায়ী সমাধান। বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা, রাজনৈতিক প্রভাব, ঠিকাদার চক্রের আধিপত্য এবং প্রশাসনিক অসহায়ত্ব যেন আর না চলে—এমনটাই দাবি স্থানীয়দের।
মানুষের জীবন ও সম্পদকে বাঁচাতে চাই সঠিক পরিকল্পনা, সময়োপযোগী বাস্তবায়ন এবং জনগণের অংশগ্রহণ—তবে বন্যা মোকাবিলার ভবিষ্যৎ বাস্তব হবে, শুধু প্রতিশ্রুতি নয়।
Leave a comment