Home ইতিহাসের পাতা বই, বিদ্যা আর ব্যারিকেড— বাংলার বাঙালির জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র ঢাকা কলেজ
ইতিহাসের পাতা

বই, বিদ্যা আর ব্যারিকেড— বাংলার বাঙালির জ্ঞানচর্চার প্রাণকেন্দ্র ঢাকা কলেজ

Share
Share

ঢাকা শহরের হৃদপিণ্ড ধানমন্ডির ব্যস্ত মিরপুর রোডে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী, নাম তার ঢাকা কলেজ। শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি বাংলার আধুনিক শিক্ষা আন্দোলনের সূতিকাগার, জাতীয় ইতিহাসের অনবদ্য প্রতিচ্ছবি। ইংরেজ শাসনামলের জটিল রাজনীতি ও সাম্রাজ্যবাদের ছায়ায় যাত্রা শুরু করে, ঢাকা কলেজ আজও তার ঐতিহ্য ও বিশালতায় ছাত্রসমাজকে আলোকিত করছে।

১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর, ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর “লর্ড অকল্যান্ড”-এর নির্দেশে এবং জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন-এর তত্ত্বাবধানে, তৎকালীন ঢাকা ইংলিশ সেমিনারি কলেজে রূপান্তরিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় “ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ”, যাকে আমরা এখন চিনি ‘ঢাকা কলেজ’ নামে। এটি ছিলো উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল শাসকের কূটনৈতিক প্রয়াস, আবার সুশিক্ষার জোয়ারে জেগে উঠেছিল বাঙালি মনন। পাশ্চাত্য শিক্ষার আলো বয়ে আনে ভাষা, দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের চর্চা, এবং প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি— যাদের হাত ধরেই বাংলায় জন্ম নেয় রেনেসাঁস।

প্রথম প্রিন্সিপাল ছিলেন হিন্দু কলেজের শিক্ষক এবং কেমব্রিজের ছাত্র জন আয়ারল্যান্ড। তার নেতৃত্বেই ঢাকা কলেজ হয়ে ওঠে সুশিক্ষা, কঠোর অনুশাসন ও পাণ্ডিত্যের কেন্দ্রস্থল। সে সময়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী ছাত্রদের ইংরেজি, ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, পদার্থবিজ্ঞান এবং মানসিক ও নৈতিক দর্শনে দক্ষ হতে হতো। পরীক্ষায় একটি বিষয়ে ফেল করলেও উত্তীর্ণ হতো না কেউ। এমন ছিল মান ও দৃষ্টিভঙ্গি।

ঢাকা কলেজের সূচনা লগ্ন থেকেই ছাত্ররা শুধু ঢাকার ছিল না— বরং ফরিদপুর, বরিশাল, যশোর, ময়মনসিংহ এমনকি ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকেও শিক্ষার্থী আসতেন। এটি একটি বহুজাতিক, বহু-ভাষাভিত্তিক পরিবেশে পরিণত হয়। এক অর্থে এটাই ছিল “মাল্টি-লিঙ্গুয়াল অ্যাকাডেমিক হাব”, যেখানে Bengali, Persian, Urdu, English এমনকি Sanskrit ভাষার ছাত্রদের নিয়ে গড়ে উঠতো ক্লাসরুম। এখানে ছাত্ররা শিখতো— Know Thyself (নিজেকে জানো), এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে।

ঢাকা কলেজের প্রথম ক্যাম্পাস ছিল বুড়িগঙ্গার তীরে। সদরঘাটে স্থাপিত ভবনের নকশা করেন কর্নেল গ্যাসর্টিন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল। ইংরেজরা অনুষ্ঠান করে, চা-পান করে, বক্তৃতা দিয়ে ভবিষ্যতের এক শিক্ষানগরীর বীজ রোপণ করে। অনুষ্ঠানটি ছিল একদম বিলাতি ধাঁচে, কিন্তু এর অভিঘাত ছিল উপমহাদেশব্যাপী।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ঢাকার ইউরোপীয় শিক্ষকরা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় কলেজটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কলেজ ভবন দখল হয়ে যায় সামরিক বাহিনীর হাতে, ক্লাস চলে যায় অস্থায়ী ভবনে। অর্থ সংকটে ভুগতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। তবুও ছাত্রদের উৎসাহ কমে না। ১৮৫৯-৬০ সালে ছাত্র সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১। ১৮৬২ সালে তা দাঁড়ায় ১৩৮-এ। এটকিনসনের রিপোর্ট অনুযায়ী এই বৃদ্ধি ছিল ১২৩%।

পরে ১৮৭৫ সালে বিজ্ঞান ক্লাস চালু হয়— যা পূর্ববাংলায় বিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক চর্চার প্রথম পদক্ষেপ। গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা পড়ানো শুরু হয়। এখান থেকেই শিক্ষার্থীরা ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে। অনেকে হয়ে উঠেন অধ্যাপক, গবেষক, রাজনীতিক ও সংস্কৃতির অগ্রপথিক।

ঢাকা কলেজের লাইব্রেরিও ছিল বিস্ময়কর। ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রন্থাগার ১৯০৮ সালের মধ্যেই ৮০০০ বই ধারণ করতো। ‘কার্জন হল’ ছিল একসময় এই লাইব্রেরির ঠিকানা। ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জনের উদ্বোধন করা এই দৃষ্টিনন্দন ভবন পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের অংশে পরিণত হয়। ২০১৩-১৪ সালে সাবেক ছাত্র মো. মোজাম্মেল হক ভূঁইয়া’র সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয় আধুনিক ‘মারুফ-শারমিন স্মৃতি গ্রন্থাগার’। বর্তমানে এটি ৫০ হাজার বইসহ একটি লাইভ রিডিং রুম, যেখানে প্রতিদিন শত শত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার পাশাপাশি ছাত্রাবাস নির্মাণের ইতিহাসও বেশ নাটকীয়। ১৮৮০ সাল পর্যন্ত নিজস্ব ছাত্রাবাস না থাকায় শিক্ষার্থীরা দুর্ভোগ পোহাতেন। পরে বাংলাবাজারে “রাজচন্দ্র হিন্দু ছাত্র হোস্টেল” তৈরি হয়, যা ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুদানে। এরপর সরকারি উদ্যোগে ১৯০৪ সালে নির্মিত হয় আধুনিক ছাত্রাবাস, যার কাঠামো আজকের সলিমুল্লাহ হল ও শহীদুল্লাহ হলের ভিত্তি রচনা করে। বিশাল ডাইনিং রুম, আধুনিক ঘরবাড়ি এবং সভাকক্ষ— এভাবেই ঢাকা কলেজ হোস্টেল হয়ে ওঠে শৃঙ্খলা ও সহাবস্থানের পাঠশালা।

কলেজটি শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, সহশিক্ষা কার্যক্রমেও অসাধারণ। ‘ঢাকা কলেজ ডিবেটিং সোসাইটি’, ‘ঢাকা কলেজ কালচারাল ক্লাব’, ‘ঢাকা কলেজ সায়েন্স ক্লাব’, ‘ঢাকা কলেজ নাট্যমঞ্চ’, ‘ঢাকা কলেজ সাংবাদিক সমিতি’, ‘ঢাকা কলেজ ক্যারিয়ার ক্লাব’ প্রভৃতি সংগঠন ছাত্রদের চিন্তা, চর্চা ও নেতৃত্ব গঠনের ক্ষেত্র করে তোলে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা এভাবেই সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও সমাজচিন্তার পথে নিজেদের গড়ে তোলে।

ঢাকা কলেজে রয়েছে চারটি অনুষদ— বিজ্ঞান, কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসা শিক্ষা। ২০টির বেশি বিভাগে পড়াশোনা করে প্রায় ১৭,০০০ শিক্ষার্থী। বর্তমান অধ্যক্ষ এ কে এম ইলিয়াস-এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি আধুনিকতায় পথচলা অব্যাহত রেখেছে।

বিশিষ্ট শিক্ষার্থী তালিকায় রয়েছে ফজলে হাসান আবেদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, হুমায়ুন আহমেদ, আকবর আলি খান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মওদুদ আহমদ, শেখ কামাল, আফরান নিশোসহ বহু গুণীজনের নাম। তারা কেউ হয়েছেন বিশ্বখ্যাত দাতব্য সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা, কেউ বিখ্যাত উপন্যাসিক, কেউ আইনজীবী, কেউ মন্ত্রী, কেউ নায়ক। তাদের জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে ঢাকার এই কলেজ গৌরব অর্জন করেছে বিশ্বব্যাপী।

তবে ঢাকা কলেজের পথচলা সবসময় নির্বিঘ্ন ছিল না। ২০১৭ সালে কলেজটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলে শিক্ষার মান ও ব্যবস্থাপনার প্রশ্নে বিতর্ক ওঠে। দীর্ঘ ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষক অসন্তোষ ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এই অধিভুক্ত বাতিল করা হয়— যা শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমাজে স্বস্তি বয়ে আনে।

ঢাকা কলেজ আজ শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি living legend, একটি শিক্ষার শাখা-প্রশাখা ছড়ানো বৃক্ষ। ইংরেজ শাসকের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠান আজ জাতীয় চেতনায় এক শক্ত ভিত্তি। ঢাকা কলেজকে কেন্দ্র করে যেমন জন্ম নিয়েছে উপমহাদেশের বহু শিক্ষা আন্দোলন, তেমনি এখান থেকেই জেগে উঠেছে বাংলার বুদ্ধিজীবী শ্রেণি।

বর্তমানে কলেজটির একাডেমিক, অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। ডিজিটাল ক্লাসরুম, অনলাইন অ্যাসেসমেন্ট, ভার্চুয়াল লাইব্রেরি, নতুন করে নির্মাণাধীন বিজ্ঞান ভবন, উন্নত ল্যাব— সব মিলিয়ে এটি ২১শ শতাব্দীর উপযোগী একটি আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠছে।

এখানে যে ছাত্র আজ ভর্তির জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, সে শুধু ডিগ্রি অর্জনের স্বপ্ন দেখে না; সে দেখে ইতিহাসের অংশ হওয়ার, জাতি গঠনে ভূমিকা রাখার স্বপ্ন। তার হাতেই রচিত হবে আগামী দিনের নতুন বাংলাদেশ, নতুন দিগন্ত।

 

Share

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Don't Miss

আজ এনসিপির বিক্ষোভ

বুধবার বিকালে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশে হামলার প্রতিবাদে আজ বৃহস্পতিবার সারা দেশে দলটি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে । এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ...

‘সুপারম্যান’ সিনেমায় ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটের ইঙ্গিত?

বিশ্বজুড়ে বক্স অফিসে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে জেমস গান পরিচালিত ডিসি কমিকসভিত্তিক নতুন সিনেমা ‘সুপারম্যান’। তবে ছবির গল্প ও দৃশ্যায়ন ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন...

Related Articles

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা

নেলসন রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা (১৮ জুলাই ১৯১৮–৫ ডিসেম্বর ২০১৩) ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের...

মাত্র ১৭ বছর বয়সে সিন্ধু বিজয় করেছিলেন যে সেনাপতি

মুহাম্মাদ বিন কাসিম আস সাকাফি ছিলেন উমাইয়া খিলাফতের অন্যতম প্রতিভাবান ও সাহসী...

শুক্রবার ও শনিবারকে সরকারি ছুটি ঘোষণা আওয়ামী লীগ সরকারের

১৯৯৭ সালের ৩০ মে, এই দিনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সরকারি...

জিয়াউর রহমান: এক সামরিক কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্রনায়কের উত্থান 

ঢাকা, ৩০ মে ২০২৫: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম জিয়াউর রহমান,...