ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের হামলায় এক মার্কিন তরুণ নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নিহত ওই যুবকের নাম সাইফুল্লাহ মুসাল্লেত, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের ট্যাম্পা শহরের বাসিন্দা। ফিলিস্তিনে অবস্থিত তাঁর স্বজনদের দেখতে গিয়ে পশ্চিম তীরের রামাল্লার উত্তরে সিঞ্জিল শহরে গত শুক্রবার এই হামলার শিকার হন তিনি। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে, অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেছে।
নিহতের পরিবার জানিয়েছে, সাইফুল্লাহ মুসাল্লেত, যিনি সাইফ আল-দিন নামেও পরিচিত, ফিলিস্তিনে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কিছুদিন থাকার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছানোর কয়েকদিন পরই এই নৃশংস হামলায় তিনি প্রাণ হারান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিহতের চাচাতো বোন ফাতমাহ মুহাম্মদ একটি পোস্টে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন এবং এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
একই সময়, মোহাম্মদ শালাবি নামের আরও এক ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের গুলিতে নিহত হন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাঁরা পশ্চিম তীরে একজন মার্কিন নাগরিকের মৃত্যুর বিষয়ে অবগত আছেন। তবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার কারণে বিস্তারিত মন্তব্য করা হয়নি।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বলছে, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের হামলা এখন নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বসতিতে আগুন দেওয়া, যানবাহন ভাঙচুর, ফিলিস্তিনি কৃষকদের জমি দখল, এমনকি সরাসরি হত্যাকাণ্ড—এ সবই যেন একটি বড় পরিকল্পনার অংশ। অধিকাংশ সময় এসব হামলার সময় ইসরায়েলি সেনারা উপস্থিত থেকে বসতি স্থাপনকারীদের নিরাপত্তা দেয়, অথচ প্রতিরোধ করতে গেলে ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, পশ্চিম তীরে গড়ে ওঠা বসতিগুলো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। এগুলোর মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণকে বিতাড়িত করে অঞ্চলটিকে ইসরায়েলিকরণ করা হচ্ছে। এমনকি ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও ২০২৩ সালের অক্টোবরের পর গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তাদের সহিংসতা বেড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও সরকারের সহযোগিতায় বসতি স্থাপনকারীরা এখন প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা করছে। সিএআইআরের উপপরিচালক এডওয়ার্ড আহমেদ মিচেল এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, “যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র আগে কোনো হত্যার বিচার করেনি, তাই ইসরায়েল এখন নির্বিচারে মার্কিন ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে।” তিনি আরও বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসন যদি মার্কিন নাগরিকের প্রাণহানির পরও চুপ থাকে, তবে তারা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নয়, বরং ‘ইসরায়েল ফার্স্ট’ নীতিতে চলছে।”
মার্কিন প্রশাসনের সমালোচনায় যুক্ত হয়েছে ইনস্টিটিউট ফর মিডল ইস্ট আন্ডারস্ট্যান্ডিং (আইএমইইউ)। এক বিবৃতিতে তারা জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের আইনি ও নৈতিক দায় হচ্ছে—ইসরায়েলি সহিংসতা বন্ধ করা। কিন্তু তারা উল্টো সেই সহিংসতার পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে।
এই ঘটনার পর হামাস এক বিবৃতিতে এ হত্যাকাণ্ডকে “বর্বরতা” আখ্যা দিয়ে এর তীব্র নিন্দা জানায়। একইসঙ্গে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের আহ্বান জানানো হয়েছে, যেন তারা বসতি স্থাপনকারী ও তাদের সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তারা এ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। তবে তারা পাল্টা অভিযোগ এনেছে যে, সহিংসতার সূত্রপাত নাকি হয়েছিল, যখন ফিলিস্তিনিরা একটি ইসরায়েলি গাড়িতে পাথর ছুঁড়ে মারে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, গাজায় চলমান অভিযানে ইসরায়েলি বাহিনী এ পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৭০০–এর বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এ হত্যাকাণ্ডকে তারা গণহত্যা বলেই মনে করছে। একইসঙ্গে পশ্চিম তীরে সহিংসতা, উচ্ছেদ এবং গণগ্রেপ্তার চলছেই।
সাইফুল্লাহ মুসাল্লেতের হত্যাকাণ্ড শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি ইসরায়েলি দখলদারিত্ব, জাতিগত দমনপীড়ন এবং আন্তর্জাতিক নীরবতার একটি প্রতিচ্ছবি। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, যদি এখনই জবাবদিহি নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে এই সহিংসতা আরও বাড়বে এবং এর বলি হবে নিরীহ সাধারণ মানুষ।
এই হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা—মানবাধিকারের আদর্শে তারা সত্যিই বিশ্বাস করে কি না, নাকি কূটনৈতিক স্বার্থে চোখ বন্ধ রেখেই চলবে।
সূত্র: আল জাজিরা
Leave a comment